কুয়ালালামপুর থেকে: স্বদেশির সঙ্গে কথা বলতে দেখে তড়পে এলেন মালয় মালিক। ব্যস্ত হাটে একটুও ফুরসত না দিয়ে একটা দড়ি ধরিয়ে দিলেন মানিকগঞ্জের সাঁটুরিয়ার ছেলে সজিবের হাতে।
একটু দূরে রাস্তার মাখঝানে আর এক বাংলাদেশি রাজু আহমেদ মালয় ভাষার যে শব্দগুলো ছন্দের তালে তালে বলে ক্রেতাদের ডাকছেন বাংলায় তার অর্থ দাঁড়ায় ‘এক আঁটি ১ টাকা, নিয়ে যান ভাই ১ টাকা’।
তার সামনে উঁচু কাঠের ওপরে মালয়েশিয়ার তিন পদের শাকের পাশে চিরচেনা কলমি শাক, ধনিয়া পাতা আর থানকুনির আঁটি। কথা শেষ করার আগেই হাত তুলে বিদায় জানালেন তিনিও।
কুয়ালালামপুরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এই জায়গাটার নাম বালাকঙ। অবস্থান তামিন জায়া এলাকায়। এখানে সন্ধ্যা সাতটাতেই ডাকাডাকি, হাঁকাহাঁকি আর দর কষাকষিতে সরগরম পাসার মালাম বা রাতের বাজার। আদল অনেকটা বাংলাদেশি হাটের।
বাংলাদেশে যেমন খোলা আকাশের নিচে হাট বসে, এখানেও তাই। তবে পার্থক্য হলো-প্রতিটি দোকানের পেছনে একটি করে দরোজা খোলা মাইক্রোবাস দাঁড়ানো। জিনিস-পত্র বিক্রির জন্য ওই বাসে করেই আনতে হয়, এখানে এটাই নিয়ম।
আর বিকাল ৪টা থেকে রাত ১০টা/১১টা পর্যন্ত চলে বলে এই হাটের নাম পাসার মালাম বা রাতের বাজার।
বালাকঙে এই হাট বসে সপ্তাহে দুই দিন। শনি আর সোমবার। সজিব-রাজুরা সেই হাটে গতর খাটান ৪০ থেকে ৫০ রিঙ্গিত (১ রিঙ্গিতে ২০ টাকা) মজুরিতে। সপ্তাহের অন্য সময় কাজ করেন কোনো কারখানায়।
মালয়, চাইনিজ আর তামিলদের পাশাপাশি অনেক বাংলাদেশি ক্রেতারও দেখা মিললো এ হাটে। রংপুরের সাইফুল ইসলাম কাজ করেন পাশের এলাকার এক ফ্যাক্টরিতে। সারা সপ্তাহের বাজার ব্যাগে ভরে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। জানালেন, তার মতো আরো অনেক বাংলাদেশি এই হাটের নিয়মিত খদ্দের।
ভর সন্ধ্যায় গিজগিজে ভিড় গোটা হাট জুড়ে। প্রচুর মানুষ। সাবলীলভাবে হাঁটা যায় না। তবে কোনো ঠেলাধাক্কা নেই। পরস্পরের প্রতি সহনশীল এই হাটের ক্রেতারা।
এই ভিড়ের মাঝেই কিনা সাউন্ড বক্সে গান বাজিয়ে ভিক্ষা করছে এ দেশীয় এক ভিক্ষুক। ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা তাক করতেই সাউন্ড বক্সের আড়ালে মাথাটা নামিয়ে নিলো সে। তার অবস্থানের কারণে চলাচলের পথটা এখানে সরু হয়ে গেছে বেশ। ভিড়টা তাই একটু বেশিই এ জায়গাটায়।
গোটা হাট জুড়ে জমে উঠেছে বিকিকিনি। গোশতের দোকানে গরু খাসির আস্ত মাথা সাজিয়ে রাখা। পাশে ভুড়িও আছে।
কলার পাতায় মোড়া এ দেশীয় এক বিশেষ খাবার বিক্রি হচ্ছে ৫ রিঙ্গিতে। আছে পোয়ে বা পাঁচ মিশালী ভাজাপোড়ার পসরা। মোটা পলিথিনে বেঁধে টানিয়ে রাখা হয়েছে আখের রস। প্রতিটি দেড় রিঙ্গিত করে।
আলু, বেগুন, সিম, বরবটি, বেগুন, লাউ, টমাটোর, মিষ্টি আলু, আদা, রসুন, পেয়াজ, কাঁচামরিটের পাশাপাশি নাম না জানা কিছু মালয় সবজি দোকানে দোকানে সাজিয়ে রাখা। আছে বিভিন্ন মাছের শুকটিও।
মালয়েশিয়ার জাতীয় ফল ডুরিয়ানের পাশাপাশি পেপে, বাঙ্গি, তরমুজ, আনারস, কলা, কাঁঠাল বিক্রি হচ্ছে ফলের দোকানে। এক ধরনের লম্বা প্রজাতির আম বিক্রি হচ্ছে ৩ কেজি ১ রিঙ্গিত দরে।
মাছের দোকানে স্থানীয় কিছু প্রজাতির পাশাপাশি বড় সাইজের ব্রিগেড আর তেলাপিয়াও চোখে পড়লো।
ভোগ্যপণ্যের বাইরে টি শার্ট, জুতা-স্যান্ডেল, চুলের কাঁটা, বেল্ট, টর্চলাইট, নানা পদের ইলেকট্রনিক পণ্য, তথা প্রয়োজনীয় সব নিত্য পণ্যেরই ধুন্ধুমার বিকিকিনি হাট জুড়ে।
কুয়ালালামপুরের হার্টপয়েন্ট বুকিত বিনতান থেকে প্রথমে মনোরেল, তারপর এলআরটি (লাইট র্যাপিড ট্রানজিট) ও কমিউটার ট্রেনে চড়ার পর মিনি বাসে করে আসতে হয়েছে এখানটায়।
কুয়ালালামপুর সিটিতে কেবল টিটিবাংসা-কেএল সেন্ট্রাল রুটেই চলাচল করে মনোরেল। ওই একটাই রুট মানব চালিত এই ট্রেনের। তাতে চড়ে প্রথমে বুকিত বিনতান থেকে হাংতুয়া জংশন, তারপর ট্রেন পালটে চালকহীন এলআরটিতে টিবিএস (টার্মিনাল বারসিপাড়ু সেলানটন)। ৩.৯০ রিঙ্গিতে একটাই টিকিট এ দুই ট্রেনের।
টিবিএস থেকে ১.৯০ রিঙ্গিতে আর এক চালকহীন ট্রেন কমিউটারে চড়ে সেরডাং।
স্টেশনের বাইরে মিনিবাস স্ট্যান্ড। ১ রিঙ্গিতে কয়েক মিনিটের ট্রাভেলে তামিন জায়া। ডানের উঁচু জায়গার যে মালয় নাম তার বাংলা উঁচু ভূমির বসতি। সেটাকে বাঁয়ে রেখে ফুটওভার ব্রিজ পেরিয়ে মিনিট দশেক হাঁটতেই বালাকং।
ফেরার পথে অবশ্য ভিন্ন রাস্তা ধরতে হলো সময় স্বল্পতায়। বাংলাদেশি ব্যবসায়ী নাজমুল হক তার মালয় স্ত্রীর হাতে রেস্তোরাঁর ভার তুলে দিয়ে গাড়িতে করে এগিয়ে দিলেন সুনগাই বেশি এলআরটি স্টেশন পর্যন্ত। সঙ্গী হিরণ বালাকঙেই রয়ে গেলেন। নাঈম ফিরলো সঙ্গে। পুডু সেন্ট্রালের ওপরে প্লাজা রাকায়েত স্টেশনে আসতে মিনিট বিশেকের বেশি লাগলো না।
***মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের জন্য আরো কিছু ব্যবসা
***ইসলামী জাদুঘরে মুসলিম মালাক্কা
***এক টিলাতেই এক ডজন জাদুঘর!
***পাহাড়ের পেটে নেমে গেছে ৫শ’ বছরের প্রাচীন সিঁড়ি
***লাল মালাক্কায় মালয়েশিয়ার প্রথম মসজিদ
** মাহাথিরের মানস সন্তান পুত্রাজায়ায়
**দেশে ফিরলেই বেকার, বিদেশের অভিজ্ঞতা বিফলে
*** দূষণে কালো হয়ে আছে কুয়ালালামপুরের জননী
***মালয়েশিয়ায় জেঁকে বসতে পারে বাংলাদেশ
***টিনঘেরা চৌহদ্দিতে ক্রীতদাস জীবন!
***লজ্জা নয় ওরা অহংকার
***মেডিকেল ট্যুরিজমের পালে হাওয়া মালয়েশিয়ায়
*** বাংলাদেশি পরিচয়েই যতো লজ্জা!
***এক ঋতুর দেশে
**বাংলাদেশি আবহে জাঁকিয়ে বসেছে হোটেল মার্ক
**অন টাইমে রিজেন্টে উড়ে মালয় দ্বীপে
**মালয়েশিয়া থেকে খবর দিচ্ছেন বাংলানিউজের জাকারিয়া মণ্ডল
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৫ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১৫
জেডএম/