নরসিংদী: পরপর দুইবার বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মির্জাচর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি জাফর ইকবাল মানিক। আর এ জনপ্রিয়তাই কাল হলো চেয়ারম্যান মানিকের।
এ ঘটনায় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মিয়াকে প্রধান আসামি করে থানায় হত্যা মামলা করা হবে জানিয়েছেন স্বজনরা। একই সঙ্গে তারা ঘাতকদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন। এরই মধ্যে সন্দেহভাজন দুইজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
শনিবার (৩ ডিসেম্বর) বিকেল ৪টায় নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মির্জাচর ইউনিয়নের শান্তিপুর স্কুলে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন স্থানীয় চেয়ারম্যান জাফর ইকবাল মানিক।
জানা যায়, গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন মো. ফিরোজ মিয়া। তার সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্ধিতা করে জয়ী হন ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি জাফর ইকবাল মানিক। এরই জেরে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। পরে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পর থেকে এলাকাছাড়া ছিল ফিরোজ সমর্থিত লোকজন।
নিহতের স্ত্রী মাহফুজা আক্তার বলেন, শুক্রবার এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অনুরোধে দুই পক্ষ বৈঠক করে। এতে কোনো সমঝোতা না হওয়ায় বৈঠক থেকে উঠে যায় প্রতিপক্ষ ফিরোজের লোকজন। পরে তারা আগে থেকেই চেয়ারম্যানকে হত্যা করার জন্য প্রস্তুত ছিল। এ খবর জানার সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারম্যানকে জানাই এবং কবির মেম্বার, গ্রাম পুলিশ নির্মলকে বিষয়টা অবগত করি যেন চেয়ারম্যান একা একা বাড়িতে না আসে। পরদিন অর্থাৎ শনিবার একটি খবর আসে চাদপুর থেকে কয়েকজন আসছে দেখা করবে। পরে চেয়ারম্যানসহ আরও কয়েকজন স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌঁছার পর ফারুকের ৪ জনের একটি সন্ত্রাসী বাহিনী তাকে লক্ষ্য করে প্রথমে একটি গুলি করে এবং পরপর মোট ৬টি গুলি করে। পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। আমি প্রশাসনের কাছে স্বামীর হত্যাকারীদের সঠিক বিচার চাই।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বাবার মৃত্যুর সংবাদে নরসিংদীর সদর হাসপাতালে এসে বাবা হারানোর শোকে আহাজারি করছেন। কোনো সান্ত্বনায় থামছে না তার কান্না। চোখ গড়িয়ে অশ্রু পড়ছে অঝোর ধারায়।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমার আব্বু কখনো সহিংসতার রাজনীতি করতো না। তিনি এলাকায় শান্তিপূর্ণ অবস্থায় বজায় রাখতে কাজ করতো। তিনি সবসময় ঝগড়া বিবাধের বিপক্ষে ছিলেন। আব্বুর এ জনপ্রিয়তা ফারুক ও তার বাবা ফিরোজ মেনে নিতে পারেনি। নির্বাচনে পরাজিত হয়ে তারা ক্ষিপ্ত ছিল। এরই জেরে খুবই নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আব্বু হত্যার বিচার চাই।
নির্বাচনের বিরোধের জের ধরে ২০১৮ সালে নিহত মানিকের ভাতিজা, চাচাতো ভাইসহ ৪ স্বজনকে গুলি করে হত্যা করে প্রতিপক্ষ। সর্বশেষ গত বছর অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পরও প্রতিপক্ষের গুলিতে মামুন নামে মানিক চেয়ারম্যানের এক সমর্থক নিহত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মিয়ার সমর্থকরা মানিক চেয়ারম্যানকে গুলি করে হত্যা করেছে বলে জানায় নিহতের ছোট ভাই মো হানিফ।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ফারুক তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। তার ভয়ে এলাকায় কোন মানুষ থাকতে পারে না। আমার ভাই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এলাকায় রাজনীতি করতো। তিনি চেয়ারম্যান থাকার সময় এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। আর তাকেই প্রকাশ্য দিবালোকে সন্ত্রাসীরা হত্যা করলো। আমি ভাই হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
তার লাশ রোববার (৪ ডিসেম্বর) দুপুরে নরসিংদী সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত করা নরসিংদী সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. তৌহিদুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, তার শরীরে বুকের উপরে ডান পাশে একটি গুলির আঘাত পেয়েছেন। ভেতরে একটি গুলির খোসা পাওয়া গেলে ও গুলি পাওয়া যায়নি।
এদিকে সন্ত্রাসীদের গুলিতে মির্জাচর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি জাফর ইকবাল মানিকের নিহতের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি জানিয়েছে জেলা যুবলীগ।
নরসিংদী জেলা যুবলীগের সভাপতি বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী বলেন, মানিক একজন জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ছিলেন। সে সবসময় ঝগড়া, মাদক আর রাহাজানির বিপক্ষে ছিল। আর এজন্য সন্ত্রাসীরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আমরা মানিক হত্যার প্রতিবাদে মির্জাচরে শোক সমাবেশ করবো, একই সঙ্গে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাবো।
এদিকে বিকেলে রায়পুরা রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু অডিটরিয়াম মাঠে চেয়ারম্যান জাফর ইকবাল মানিকের প্রথম জানাজা হয়। পরে নিহতের নিজ বাড়িতে রাতে দ্বিতীয় জানাজা শেষে মরদেহ দাফন করা হয়।
বিকেলে রাজু অডিটরিয়াম মাঠে জানাজা শুরুর আগে নরসিংদী-৫ আসনের সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু বলেন, চেয়ারম্যান জাফর ইকবাল মানিক অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। তার হত্যাকারীদের কঠিন বিচারের আওতায় আনার জন্য স্থানীয় প্রসাসনকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন, নরসিংদী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মনির হোসেন ভূইয়া, রায়পুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজগর হোসেন, রায়পুরা পৌর মেয়র জামাল মোল্লা, রায়পুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজিজুর রহমান, নরসিংদী জেলা যুবলীগ সভাপতি বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী, সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান শামীম নেওয়াজ, উপজেলা যুবলীগ সভাপতি মিলন মাস্টারসহ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও নিহতের স্বজনরা।
জানাজা শেষে চেয়ারম্যান জাফর ইকবাল মানিকের স্মরণে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু এমপি, আ.লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
রোববার (৪ ডিসেম্বর) দুপুরে চেয়ারম্যান হত্যার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম। তিনি ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটনসহ ঘটনার সঙ্গে জড়িত আসামিদের শনাক্ত করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তারের নির্দেশনা প্রদান করেন।
নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. আল আমিন জানান, হত্যাকাণ্ডের পর এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। এ ঘটনায় ২ জনকে আটক করা হয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তিনি তাদের নাম পরিচয় জানাননি।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৪, ২০২২
জেএইচ