ঢাকা: ভোলা জেলার চরফ্যাশনে ভূমিহীন এক নারী হত্যার ঘটনায় বিচারের দাবিতে রাজধানীতে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মঙ্গলবার (০৬ ডিসেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সালাম মিলনায়তনে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এএলআরডি, টিআইবি, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, নিজেরা করি, বেলা, ব্লাস্ট, মানবাধিকার, সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের উদ্যোগে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে এএলআরডির সহকারী কর্মসূচি সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট রফিক আহমেদ সিরাজী লিখিত বক্তব্যে বলেন, ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলাধীন চর মুজিবনগরের (চর শিকদার) প্রায় ৯০০ ভূমিহীন পরিবার চরের জমিতে বন্দোবস্ত পাওয়ার জন্য বিগত ৪ বছর থেকে সংগ্রাম করে আসছে। আগে এই চরের জমিতে তারা একসনা বন্দোবন্ত পেয়েছিল। পরবর্তীতে তাদের এই বন্দোবস্ত নবায়ন করেনি। এই বিষয়ে মুজিবনগর ইউনিয়ন ভূমিহীন সমবায় সমিতি লিমিটেডের পক্ষে বন্দোবস্ত পাওয়ার লক্ষ্যে মহামান্য হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করা হয়। মহামান্য আদালত দুই পক্ষের শুনানি শেষে ৩রা এপ্রিল, ২০১৮ তারিখ ভোলা জেলা প্রশাসককে আদেশ হাতে পাওয়ার ১ মাসের মধ্যে বন্দোবস্তের বিষয়টি সুরাহা করতে আদেশ দেন। যদিও তৎকালীন জেলা প্রশাসক এ বিষয়ে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেননি। বর্তমান জেলা প্রশাসক মো. তৌফিক-ই-ইলাহী যোগদান করার পর তিনি বিষয়টি সুরাহা করার উদ্যোগ নেন। ঠিক সেই সময় চর দখল করে রাখা জোতদার ও প্রভাবশালীরা কিছু ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে এ জমি তাদের বলে দাবি করেন। যা আদতে সত্য নয়। কারণ চর মুজিবনগর পয়ছি জমি এবং যেহেতু এখনও দিয়ারা জরিপ সম্পন্ন হয়নি তাই তা কোনো ব্যক্তির নামে হওয়ার সুযোগ নাই। এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও আদালত এই কাগজ অবৈধ ঘোষণা করেন।
এরপর ১২ এপ্রিল, ২০২২ তারিখে ভোলার রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর মুহাম্মদ আরাফাত হুসাইন চরফ্যাশন সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) বন্দোবস্ত দেওয়ার ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। সেই মোতাবেক তৎকালীন এসি ল্যান্ড ভূমিহীনদের চরের জমিতে চাষাবাদ করতে বলেন। এবং অবৈধ দখলদারকে সেখান থেকে সরে যেতে বলেন। এতেই চরের অবৈধ দখলদার ভূমিগ্রাসীরা মুজিবনগর ইউনিয়ন ভূমিহীন সমবায় সমিতি লিমিটেডের নেতা আলম বাচ্চুর ওপর ক্ষিপ্ত হয় এবং তাকে ও তার পরিবারকে মেরে ফেলার হুমকি দিতে থাকে। এর প্রেক্ষিতে আলম বাচ্চুর স্ত্রী বকুল ১৩/০৪/২০২২ তারিখ দুলারহাট থানায় জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে অভিযোগ দাখিল করে। কিন্তু থানা পুলিশ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ভোলা জেলা প্রশাসক ও ভোলা পুলিশ সুপারের কাছে তিনি ১৭/০৪/২০২২ তারিখ জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে চিঠি দেন।
কিন্তু এরপরও পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো প্রায় প্রতি মাসেই ভূমিহীনদের বিরুদ্ধে একের পর এক গাছ কাটার মামলা, চুরির মামলা, ছিনতাইয়ের মামলা প্রভৃতি মিথ্যা মামলা দায়ের করতে থাকে। এবং এ সব মামলায় স্থানীয় পুলিশকে আসামি ধরতে বেশ তৎপর দেখা যায়। ভূমিহীনরা আদালতে হাজিরা দিতে দিতে অসহায় হয়ে পড়ছে।
সর্বশেষ গত ৩০ নভেম্বর রাত আনুমানিক ১টা থেকে দেড়টার মধ্যে ১৪/১৫ জন সন্ত্রাসী আলম বাচ্চুর বাড়িতে ধারালো অস্ত্র-শস্ত্রসহ আক্রমণ করে। বাড়ির ভেতরে আলম বাচ্চুর স্ত্রী বকুল ও তার বড় বোন মুকুল ছিল। মুকুল কয়েকদিন আগেই খুলনা থেকে বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। ভোলায় মামলার হাজিরা দিতে যাওয়ায় আলম বাচ্চু সেইদিন বাড়িতে ছিলেন না। সন্ত্রাসীরা বাড়িতে ঢুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে বকুল এবং মুকুলকে উপর্যপুরি কোপাতে থাকে। বকুলের শরীরে ২২টি দায়ের কোপের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তার হাতে ৩টি এবং মাথায় দুটি দায়ের কোপের চিহ্ন রয়েছে। সন্ত্রাসীরা তাদের দা দিয়ে কোপাতে কোপাতে ঘর থেকে বাইরে বের করে নিয়ে আসে এবং ফেলে রেখে চলে যায়। এ ঘটনায় বকুলের মৃত্যু হয়।
ঘটনার পরদিন সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে দুলারহাট থানা পুলিশ সেখানে হাজির হয়। তারা লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে এবং কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলেন। তবে, প্রত্যক্ষদর্শী না থাকায় এবং আহত মুকুল বেগম কাউকে না চেনায় এ ঘটনায় তারা কোনো মামলা নেয়নি।
সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে কয়েকটি সুস্পষ্ট দাবি জানানো হয়।
১. এই নৃশংস ভূমিহীন নারী নির্যাতন ও হত্যার জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ট্রাইব্যুনালের মাধ্যম দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই মামলার বিচার সম্পন্ন করতে হবে।
২. চরে বসবাসরত নারী ও শিশুসহ সব ভূমিহীনের নিরাপত্তার নিশ্চিত করার জন্য দৃশ্যমান কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে ঐ এলাকায় বিশেষ পুলিশ ফাড়ি বসানোর নিশ্চয়তা দিতে হবে।
৩. জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের আশ্বাসের ভিত্তিতে তারা চরে যে ধানের আবাদ করেছে, সে ফসল যেন নির্বিঘ্নে ঘরে তুলতে পারেন তার জন্য জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে যথোপোযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪. উক্ত চর মুজিবনগরে দিয়ারা জরিপ সম্পন্ন করে খাসজমি বন্দোবস্ত নীতিমালা অনুসারে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসহ চরের ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য রাখেন এএলআরডির সহকারী কর্মসূচি সমন্বয় সহায়তাকারী অ্যাডভোকেট রফিক আহমেদ সিরাজী, শামসুল হুদা, রেজাউল করিম, কাজল দেবনাথ, বদরুল আলম, আসলাম বাচ্চু, নিহত বকুলের বড় ভাই সুলাইমান তালুকদার, বেলাল তালুকদার সহ অন্যান্যরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০২২
এমকে/এসএ