নোয়াখালী: স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততায় সরকারি বেসরকারি নানা উদ্যোগের ফলে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু রোধে অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলা। এ উপজেলার কোথাও এখন আর বাড়িতে অদক্ষ ধাত্রী দিয়ে সন্তান প্রসব করানো হয় না।
উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে স্বাস্থ্য ও পরিবার কেন্দ্রগুলো হয়ে উঠেছে প্রসূতি মায়েদের ভরসাস্থল। সেখানে সম্পূর্ণ বিনা খরচে সার্বক্ষণিক প্রসব সেবা নিশ্চিত করার মধ্যদিয়ে উপজেলাটিকে ‘শতভাগ প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব সেবা নিশ্চিতকরণ মডেল উপজেলা’ ঘোষণা করা হয়েছে।
কবিরহাট উপজেলায় এক মায়ের শিশু সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছে বাড়ির পাশে ধানশালিক ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব সেবা শিশুটি পৃথিবীর আলোতে এখন হাসছে। এর আগে গত চার বছরে বাড়িতে অদক্ষ ধাত্রী দিয়ে ডেলিভারির কারণে ওই মায়ের আরও দুটি সন্তান পৃথিবীর আলো দেখার আগেই মারা যায়। এ রকম ঘটনায় এ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাড়িতে অদক্ষ ধাত্রী দিয়ে ডেলিভারির কারণে অনেক মাকে মৃত সন্তান জন্ম দিতে হয়েছে। এমনকি ডেলিভারির সময় মৃত্যু হয়েছে অনেক মায়ের।
তখন জনবল সংকট ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে ইউনিয়নে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলো অকার্যকর ও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল। এই পরিস্থিতিতে ২০২০ সালের মধ্যভাগে সাবেক জেলা প্রশাসক মো. খোরশেদ আলম খানের উদ্যোগে জেলা প্রশাসন, পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ, ইউএসএআইডি মা-মনি ও সেভ দ্যা চিলড্রেন দুই প্রকল্প মিলে স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানিক প্রসব সেবা নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
এরপর জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততায় ইউনিয়ন পর্যায়ে ৬টি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে এবং একটি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে জনবল নিয়োগ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়। সবার সহায়তায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে সার্বক্ষণিক প্রসব সেবা দেওয়ার উপযোগী করে তোলা হয়। এখন সেখানে ২৪ ঘণ্টা সম্পূর্ণ বিনা খরচে গর্ভবতী মায়েদের প্রসবপূর্ব, প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী সব ধরণের সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কবিরহাট উপজেলাকে ‘শতভাগ প্রতিষ্ঠানিক প্রসব সেবা নিশ্চিতকরণ মডেল উপজেলা’ ঘোষণা করা হয়। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী শুধু কবিরহাট উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে গত তিন মাসে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে গর্ভবতী সেবা নেন ৩ হাজার ৯৮৫ জন, প্রাতিষ্ঠানিক স্বাভাবিক প্রসব সেবা নেন ৫৬৭ জন এবং প্রসবোত্তর সেবা নেন ১ হাজার ৮৯০ জন। এ সময় প্রসবকালীর কোন মায়ের মৃত্যৃ হয়নি। আর শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে ৪৫ ভাগ।
বাটাইয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপ-সহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার জেকলিন আক্তার জানান, এখানে আমরা গর্ভবতী মায়েদের প্রসবপূর্ব এবং প্রসব পরবর্তী সেবা দুটোই দিতে থাকি। তবে আগে এ সেবাটি ছিলো না। জেলা প্রশাসক আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, বাড়িতে যেন কোনো ধরণের ডেলিভারি না হয়, কারণ বাড়িতে ডেলিভারি ঝূঁকিপূর্ণ। এতে মা ও শিশুর জীবন মৃত্যুঝূঁকিতে থাকে। এখন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি হওয়াতে মা ও শিশু উভয়ই ঝূঁকিমুক্ত। এতে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষ উপকৃত হচ্ছেন।
ধানশালিক ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপ-সহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার রুহুল আমিন জানান, গত মাসে আমাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৪০টির উপরে নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। পাশাপাশি আমরা প্রসবপূর্ব চেকআপ গুলো নিয়মিত পাচ্ছি। এতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের ইউনিয়নে সব ডেলিভারি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হচ্ছে। বাড়িতে কোনো ডেলিভারি হচ্ছে না। প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবসেবায় আমরা শতভাগ সফল।
ইউএসএআইডি মা-মনি’র প্যারা মেডিকস (দক্ষ ধাত্রী) রেবেনা আক্তার জানান, ধানশালিক ইউনিয়নে আগে অদক্ষ ধাত্রী দিয়ে বাড়িতে ডেলিভারি করার কারণে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার অনেক বেশি ছিলো। বর্তমান সরকার উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যখাতে নানা উদ্যোগ, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করায় এবং আমাদের মতো প্রশিক্ষিত দক্ষ ধাত্রী দ্বারায় প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবসেবার উদ্যোগ নেওয়ায় এখন মাতৃমৃত্যু শূণ্য এবং শিশু মৃত্যুর হার অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে।
প্রসব সেবা গ্রহীতা উপকারভোগীরা জানান, আগে আমাদের গর্ভবতী মায়েদের ডেলিভারি বাড়িতে হতো। সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পেতাম না। আমাদের অসচেতনতা ও বাড়িতে ডেলিভারির কারণে ঝূঁকিতে থাকতাম। অনেক সময় মা ও শিশু উভয়ের জীবন চলে যেতো। এখন সরকারি সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে দক্ষ ধাত্রী, ডাক্তার, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধ সব পাওয়া যায়। সেবার মান ভালো হওয়ায় সবাই এখন প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব সেবাতেই আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
কবিরহাট উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ লোকমান হোসেন জানান, কবিরহাট উপজেলার প্রত্যেকটা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে ২৪ ঘন্টা সাতদিন নরমাল ডেলিভারি দেওয়া শুরু করি। বাংলাদেশে একটা উপজেলার প্রত্যেকটি ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব সেবা শুরু করাটা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। এটা বাংলাদেশের আর অন্য কোন উপজেলায় নাই। একমাত্র কবিরহাট উপজেলায় এই কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ২০২০ সালে আমরা তৎকালীন জেলা প্রশাসক খোরশেদ আলম খান উদ্যোগ নেন। ২০২১ সাল থেকে আমরা চ্যালেঞ্জটা মোকবেলা করি।
তিনি আরও জানান, এখন ২০২২ সালে এসে আমরা প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবসেবা শতভাগ নিশ্চিত করি। আশা করছি এটি নোয়াখালীর অন্যান্য উপজেলাতেও ছড়িয়ে দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে সূবর্ণচর হাতিয়া উপজেলায় আমরা জিরো হোম ডেলিভারি শুরু করেছি। সরকার যদি প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব সেবায় কবিরহাট মডেল উপজেলাকে গ্রহণ করে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়, তাহলে সারা বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হারে একটা আমূল পরিবর্তন হবে। শতভাগ প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবসেবা নিশ্চিত হলে মা ও শিশু মৃত্যু কমে যাবে এবং মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের উন্নয়নে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন হবে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইসরাত সাদমীন জানান, এ সাফল্য ধরে রাখতে নিয়মিত উঠান বৈঠক এবং হাট বাজার ও বাড়িতে বাড়িতে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব সেবা গ্রহণে মায়েদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব কার্যক্রম মনিটরিং এর পাশাপাশি সেবাগ্রহীতাদের মতামত নেওয়া হচ্ছে।
‘শতভাগ প্রতিষ্ঠানিক প্রসব সেবা নিশ্চিতকরণ মডেল উপজেলা’ ধারণাটি পুরো জেলায় এবং পর্যায়ক্রমে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ ও সেভ দ্যা চিলড্রেনের কর্মকর্তারা।
জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততায় সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে ‘শতভাগ প্রতিষ্ঠানিক প্রসব সেবা নিশ্চিতকরণ মডেল উপজেলা’ ধারণাটি দেশে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু রোধে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপণ করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০২২
এসএম