ঢাকা, শুক্রবার, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বছর বছর ড্রেজিং করেও নৌপথে নাব্য সংকট

মুশফিক সৌরভ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২৩
বছর বছর ড্রেজিং করেও নৌপথে নাব্য সংকট

বরিশাল: বর্ষায় দেশের নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পায় আর শীতে অর্থাৎ শুষ্ক মৌসুমে তা কমে যায়, এটাই স্বাভাবিক বা প্রকৃতির নিয়ম। শুষ্ক মৌসুমে বরিশাল-ঢাকা নৌরুট সচল রাখতে প্রতি বছরই বিভিন্ন স্থানে ড্রেজিং বা খনন কাজ করে থাকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।

তবে বছর বছর এমন ড্রেজিং নিয়ে আগে থেকেই যাত্রীবাহী নৌযান শ্রমিক ও মালিকদের মতের ভিন্নতা রয়েছে। তাদের মতে এভাবে বছর বছর অস্থায়ীভাবে খনন কাজ না করে নৌপথে পরিকল্পিতভাবে টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী খনন কাজ করার।

যদিও বৈচিত্র্যের কারণে সার্বিক দিক মিলিয়ে দক্ষিণের বেশ কিছু নদীর বেশ কিছু পয়েন্টে মেইনটেনেন্স ড্রেজিং প্রতি বছরই করা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএ’র খনন বিভাগের প্রকৌশলীরা।

যাত্রীবাহী নৌযানের চালকসহ অভিজ্ঞরা বলছেন, নিয়মানুযায়ী পণ্য ও যাত্রীবাহী নৌযান নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য কমপক্ষে ১২ মিটার গভীরতার প্রয়োজন আছে নৌপথে। তবে ঢাকা-বরিশাল নৌপথে যাত্রীবাহী নৌযানগুলোর আকার অনুযায়ী ৮ মিটার গভীর পানি থাকলেও চলাচল সম্ভব। কিন্তু কিছু কিছু জায়গা রয়েছে যেখানে ভাটিতে দুই-তিন মিটার পানি পাওয়া যায়, আবার জোয়ারেও সেখানে পানি আহামরি বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তাই সেসব জায়গা দিয়ে নৌযান চালাতে হলে ভরা জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। আবার নির্ধারিত পথ বাদ দিয়ে ১৫-২০ কিলোমিটার বেশি পথ ঘুরেও নৌযান চালাচ্ছে অনেকে। এতে সময় এবং খরচ উভয় বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানান তারা।

ডুবোচর ও নাব্য সংকট বরিশাল ও চাঁদপুরের সীমানায় থাকা নদীর অংশে বেশি হওয়ায় বিভাগের ৬ জেলাতে চলাচলকারী নৌযানগুলোকে ভাটার সময় সতর্ক হয়ে চলতে হয়। নয়তো নৌযান আটকে গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেষ্টা করে তা ছাড়াতে হয়।

বিলাসবহুল এমভি সুন্দরবন-১৬ লঞ্চের প্রথম শ্রেণির মাস্টার মো. মজিবুর রহমান বলেন, ঢাকা-বরিশাল রুটের নলবুনিয়া থেকে ভবনী পযর্ন্ত দেড় থেকে দুই কিলোমিটার, হিজলা থেকে বাবুগঞ্জ পযর্ন্ত তিন কিলোমিটার, মেহেন্দিগঞ্জর উলানিয়া থেকে শেওড়া পযর্ন্ত তিন কিলোমিটার নদী পথে অসংখ্য ডুবোচর রয়েছে।

এছাড়া বাউশিয়া-নলবুনিয়া চ্যানেল, বরিশালের শায়েস্তাবাদ সংলগ্ন কীর্তনখোলা ও আড়িয়াল খাঁসহ তিন নদীর মোহনা এবং বরিশাল টার্মিনালসংলগ্ন কীর্তনখোলা নদীতে নাব্য সংকট চরম আকারে।



এদিকে ঢাকা-বরিশাল রুটের আলোচিত মিয়ার চর চ্যানেলটি বর্ষা শেষ হওয়ার আগে থেকেই বন্ধ রয়েছে জানিয়ে মাস্টার মজিবুর রহমান বলেন, চ্যানেলটি বিআইডাব্লিউটিএ অনুমোদিত নৌপথ না হলেও সময় ও খরচ বেঁচে যাওয়ায় লঞ্চ মালিক ও চালকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।

অপরদিকে সুন্দরবন-১১ লঞ্চের মাস্টার আলমগীর হোসেন বলেন, বরিশাল-ঢাকা নৌপথে বরিশাল নদীবন্দর থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত পাঁচ-ছয়টি স্থান নাব্যতা সংকটের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চরশিবলী, নলবুনিয়া, বামনির চর, হিজলা ও মল্লিকপুর চ্যানেলটি সহজ পথ থাকলেও চ্যানেলের বিভিন্ন স্থানে চর জেগে তা বন্ধ হয়ে গেছে। বিআইডাব্লিউটিএ’র নির্ধারিত চ্যানেল মেঘনার উলানিয়া-কালীগঞ্জ হয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। এতে গন্তব্যে পৌঁছাতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় ও জ্বালানি তেলের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।

অপরদিকে ভোলা, বরগুনা ও পটুয়াখালীতে চলাচলকারী লঞ্চের চালকরা জানান, ভোলার ভেদুরিয়াসহ বরিশালের বাকেরগঞ্জের কারখানা নদীসহ কবাই ও পটুয়াখালী লঞ্চঘাট সংলগ্ন এলাকায় নৌপথে পানি কম রয়েছে। এছাড়া বরগুনার খাকদন ও বিষখালী নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ডুবোচরের কারণে প্রায়ই নৌযান আটকে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।

বরিশালের অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহারকারীরা বলছেন, বরিশালের লাহারহাট ফেরিঘাট এবং মেহেন্দীগঞ্জের পাতারহাট লঞ্চঘাট সংলগ্ন এলাকায় উলানিয়া, ভাষানচর, মেঘনা নদীর হিজলার মিয়ার চর, কালিগঞ্জ এলাকার বিভিন্ন স্থানেও ডুবোচর ও নাব্য সংকট রয়েছে। এমতাবস্থায় চলমান মৌসুমে সরকারি উদ্যোগে কোটি টাকা ব্যয়ে খনন কাজ করা হলেও কার্যত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।

প্রথম শ্রেণির মাস্টার আবুল কালাম আজাদ ও মো. জাহিদ জানান, বরিশাল নদীবন্দর সংলগ্ন কীর্তনখোলা নদীতে খনন কাজ চলছে। কিন্তু এই খননকাজের কোনো নির্দিষ্ট সময় না থাকায় আমাদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। আবার নদীবন্দরের পল্টুনগুলো সরিয়ে ভালোভাবে খনন করার দাবি জানানো হলেও ব্যয় বৃদ্ধি কথা বলে তা করা হয়নি।  এতে করে পন্টুনের নিচে থাকা বালু অল্প সময়েই বার্দিং (নোঙ্গর) প্লেসে চলে আসবে, তখন আবার ড্রেজিং করতে হবে।  তবে এর আগে যে কয়েক বছর পন্টুন সরিয়ে ভালোভাবে খনন করা হয়েছে, তাতে দীর্ঘমেয়াদি সুফল পেয়েছি আমরা।

সুন্দরবন নেভিগেশনের পরিচালক সাইফুল ইসলাম পিন্টু বলেন, মেশিনের মাধ্যমে খননকৃত বালু বা পলি কিছুটা দূরে আবার নদীতেই ফেলা হচ্ছে। কিন্তু এই বালু নদীতে না ফেলে নিকটবর্তী চরে কিংবা অন্যত্র জায়গা করে ফেলার অনুরোধ জানিয়ে আসছি আমরা। কার্যত এ কথা কেউ শুনছে না। নদীর পলি নদীতে ফেলায় পরের বছর আশপাশেই আবার নাব্য সংকট দেখা দিচ্ছে।

নিজাম শিপিং লাইন্সের স্বত্বাধিকারী নিজামুল ইসলাম বলেন, ঢাকা-বরিশাল নৌরুট বাঁচাতে হলে পরিকল্পিত টেকসই ড্রেজিং ব্যবস্থা নিতে হবে। অপরিকল্পিত ড্রেজিং ব্যবস্থা দিয়ে নৌ-চলাচল নির্বিঘ্ন করা যাবে না। বরং নদী খননের নামে সরকারের প্রতি বছর কোটি টাকা গচ্চা যাবে।

বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মিজানুর রহমান ভূঁইয়া জানান, জায়গা না পাওয়ায় বরিশাল নদীবন্দর সংলগ্ন কীর্তনখোলার পলি কেটে নদীর গভীরতম এবং খরস্রোতা জায়গায় ফেলা হচ্ছে, যা খননকৃত এলাকায় এসে আবার ভরাট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক আব্দুল মতিন সরকার জানান, মূলত নদ-নদীতে নভেম্বর মাস থেকে নাব্য সংকট দেখা দেয়। তবে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে এসে এ সংকট বৃদ্ধি পায়। দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথ সচল রাখতে ২০টির বেশি নদীতে ৪৭টি এলাকায় ৩০ লাখ ঘনমিটার নদীর পলি/বালু ড্রেজিং করা হবে। এর জন্য ইতোমধ্যে ১২টি ড্রেজার কাজ করছে, তারপরও লঞ্চ মালিক ও মাস্টাররা বর্তমানে যেসব অভিযোগ করেছেন সেগুলো খতিয়ে দেখা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২৩
এমএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।