ঢাকা: ভারতের উদ্যোগে ভয়েস অব গ্লোবাল সাউথ শীর্ষ সম্মেলনে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বেশ কয়েকটি নতুন উদ্যোগের বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছেন।
উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১. আরোগ্য মৈত্রী ২. গ্লোবাল সাউথ সেন্টার অব এক্সিলেন্স ৩. গ্লোবাল সাউথ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইনিশিয়েটিভ ৪. গ্লোবাল সাউথ ইয়ং ডিপ্লোম্যাটস ফোরাম ও ৫.গ্লোবাল সাউথ স্কলারশিপস।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ১২ ও ১৩ জানুয়ারি দুই দিনব্যাপী ভয়েস অব গ্লোবাল সাউথ শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করে ভারত। মোট ১০টি সেশনের এই সম্মেলনটি ভার্চুয়াল ফরম্যাটে অনুষ্ঠিত হয়। এ আয়োজনে বিশ্বব্যাপী দক্ষিণের ১২৫টি দেশের নেতা ও মন্ত্রীরা অংশগ্রহণ করেন।
উন্নয়নশীল বিশ্বের অগ্রাধিকার, দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্বেগের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার জন্য ভারত এ অনন্য সম্মেলনটির আহ্বান জানায় যা আগে কখনও ঘটেনি। সম্মেলনটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক কারণ বর্তমান পৃথিবী স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা, সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি প্রাপ্তির সুযোগ, জলবায়ু সংক্রান্ত অর্থায়ন ও প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ দিয়ে ভরপুর একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে। যে সকল আন্তঃসংযুক্ত বিপদের ক্ষতিকর প্রভাবের মুখোমুখি আছে সেগুলোর কারণে জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশ যে ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তার একটি সময়োপযোগী অনুস্মারক হলো এই শীর্ষ সম্মেলন।
গত ১২ জানুয়ারি উদ্বোধনী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এর পরে মন্ত্রী পর্যায়ে বিষয়ভিত্তিক আটটি অধিবেশন ছিল যেগুলোর উদ্দেশ্য ছিল উন্নয়নশীল বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগসমূহের মোকাবিলা করা। ১৩ জানুয়ারি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পরিচালনায় সমাপনী নেতাদের একটি অধিবেশনের মাধ্যমে শীর্ষ সম্মেলনটি শেষ হয়। গুরুত্বপূর্ণ সংকটকালে এ সম্মেলন আয়োজন করার জন্য অংশগ্রহণকারী নেতারা নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বের প্রশংসা করেন ও অভিনন্দন জানান। তারা আশা প্রকাশ করেন, সম্মেলনটি বিশ্বের জন্য একটি সমৃদ্ধ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী দক্ষিণ দেশগুলোর চাহিদার কথা বিবেচনা করে একটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার উদ্বোধনী বক্তব্যে উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মূল বিষয়গুলো তুলে ধরেন। তিনি পরিবর্তনের জন্য একটি সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি ও এজেন্ডা প্রণয়নের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী দক্ষিণের দেশগুলোর সমাজ ও অর্থনীতির উন্নতির সুযোগের ওপর গুরুত্ব দেন। এই প্রচেষ্টায় তিনি সহজ, পরিমাপযোগ্য ও টেকসই সমাধানের ক্ষেত্রে ভারতের অভিজ্ঞতা বিনিময় করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি ভ্যাকসিন উন্নয়ন, বায়োমেট্রিক উপায়ে শনাক্তকরণ, ডিজিটাল পাবলিক পণ্য, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, স্যাটেলাইট প্রযুক্তি, ডিজিটাল গভর্ন্যান্স, লাস্ট মাইল কানেক্টিভিটি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভারতের অর্জনসমূহ তুলে ধরেন। উন্নয়নশীল বিশ্বের যে প্রযুক্তি, জ্ঞান ও ক্রিটিকাল রিসোর্স লাভ করার চাহিদাও রয়েছে সেটি নিয়েও তিনি কথা বলেন। একটি নতুন মানবকেন্দ্রিক উন্নয়নের দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য তার আহ্বান অংশগ্রহণকারী নেতাদের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন পায়।
অর্থমন্ত্রীদের অধিবেশনে, মন্ত্রীরা বিশ্বব্যাপী দক্ষিণ দেশগুলোর উন্নয়ন চাহিদার ক্ষেত্রে অর্থায়ন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি অর্জন, আর্থিক খাতে ডিজিটাল পাবলিক পণ্য বাস্তবায়ন এবং ফলাফলভিত্তিক ও আর্থিকভাবে টেকসই উন্নয়ন অংশীদারিত্বের বিষয়ে মতবিনিময় করেন।
পরিবেশবিষয়ক মন্ত্রীদের অধিবেশনে উন্নয়ন ও স্থায়িত্বের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণে সর্বোত্তম অনুশীলনসমূহ বিনিময় করা এবং ২০২২ সালের অক্টোবরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সূচনা করা লাইফ বা ‘পরিবেশের জন্য জীবনধারা’-র গুরুত্বের ওপর মনোনিবেশ করা হয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের অধিবেশনে, মন্ত্রীরা আন্তর্জাতিক ল্যান্ডস্কেপের ক্রমবর্ধমান বিভক্তির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা বিশ্বব্যাপী দক্ষিণের দেশগুলোর উন্নয়ন অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময় করেন। মন্ত্রীরা খাদ্য, জ্বালানি ও সারের ঘাটতির ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। তারা সমসাময়িক বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে এমন নবায়নযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বহুপাক্ষিকতারও আহ্বান জানিয়েছেন। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তাদের সম্মিলিত আওয়াজ তোলার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
জ্বালানিবিষয়ক মন্ত্রীদের অধিবেশন বিশ্বব্যাপী উন্নতি ও মানব উন্নয়নের জন্য জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সংকটাপন্ন অবস্থার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতার মধ্যে জ্বালানি প্রাপ্তির সুযোগ, জ্বালানির উৎসে বৈচিত্র আনার মাধ্যমে জ্বালানির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা, নবায়নযোগ্য ও বিকল্প জ্বালানির উদ্ভাবন ও বিকাশের জন্য সর্বোত্তম অনুশীলনগুলোর বিনিময় করা এবং জৈব জ্বালানির সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো ছিল আলোচনার মূল বিষয়।
বাণিজ্যবিষয়ক মন্ত্রীদের অধিবেশনে মন্ত্রীরা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ব্যবসা এবং বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করার কৌশলসমূহ বিনিময় করেন। সেইসঙ্গে যোগাযোগ ও বাণিজ্যের উন্নয়ন ঘটানো, ক্রিটিকাল প্রযুক্তি ও সম্পদের প্রাপ্তি নিশ্চিত করা, তৃণমূল পর্যায়ে উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা ও সর্বোত্তম অনুশীলনগুলো বিনিময় করা এবং সরবরাহ চেইনে বৈচিত্র্য আনার বিষয়ে বলা হয়। সেখানে মন্ত্রীরা একমত হন যে, অতিমারি পরবর্তী সময়ে প্রক্রিয়াসমূহ সহজীকরণ, প্রযুক্তিভিত্তিক সমাধান বাস্তবায়ন, অবকাঠামোতে বিনিয়োগ এবং বৈশ্বিক বাজারে ন্যায়সঙ্গত অ্যাক্সেস নিশ্চিত করার ওপর একটি টেকসই পুনরুদ্ধার ব্যবস্থা নির্ভর করবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীদের অধিবেশনে, অংশগ্রহণকারীবৃন্দ বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। স্বাস্থ্যসেবায় ডিজিটাল পাবলিক পণ্যের বিকাশ, গতানুগতিক ঔষধের প্রসার, জনসাধারণের মাঝে সক্ষমতা সৃষ্টি এবং আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক বিকাশের পন্থা ও পদ্ধতি এবং জ্ঞানের বিনিময় নিয়ে আলোচনা করা হয়। দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিফলন হিসেবে মন্ত্রীরা কোভিড অতিমারি চলাকালে ভারতের ‘ভ্যাকসিন মৈত্রী’ উদ্যোগের বিশেষ প্রশংসা করেন।
শিক্ষামন্ত্রীদের অধিবেশনে, ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জ্ঞানভিত্তিক সমাজে রূপান্তরিত করার চিন্তাধারা বিনিময় করা হয়। মন্ত্রীরা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষায় সমতা ও গুণমান প্রদানের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহারে সর্বোত্তম অনুশীলনসমূহ বিনিময় করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে কথা বলেন। ভারত তার জাতীয় শিক্ষানীতি বিনিময় করেছে যা প্রবেশাধিকার, সমতা, গুণমান, সহজলভ্যতা ও জবাবদিহিতার মূল স্তম্ভের বিনির্মিত।
ভারতের জি২০ প্রেসিডেন্সি-সংক্রান্ত চিন্তাধারা বিনিময়ের জন্য নিবেদিত অধিবেশনে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জি২০ প্রেসিডেন্সির ক্ষেত্রে ভারতের মূল অগ্রাধিকারগুলো বিনিময় করেন। তিনি আশ্বাসও দেন যে ভারত ভয়েস অব গ্লোবাল সাউথ শীর্ষ সম্মেলনে অংশীদার দেশগুলোর দেওয়া মূল্যবান মতামতগুলো যেন জি২০ আলোচনাসহ বিশ্বব্যাপী যথাযথ স্বীকৃতি পায় সেটি নিশ্চিত করতে কাজ করবে।
অংশগ্রহণকারী দেশগুলো প্রশংসার সঙ্গে স্বীকৃতি দেয় যে, এই শীর্ষ সম্মেলনে ফলপ্রসূ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। একটি কার্যনির্ভর এজেন্ডার মাধ্যমে একটি নতুন পথ নির্ধারিত হয়েছে যা তাদের অগ্রাধিকারগুলোতে গুরুত্ব দিয়ে চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবেলা করার প্রচেষ্টা চালাবে। তারা এজেন্ডা বাস্তবায়ন ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের সমাধানের জন্য অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সর্ববৃহৎ অংশীদার, বিশ্বব্যাপী দক্ষিণ দেশগুলোর কণ্ঠস্বরকে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে জোর দেন।
বাংলাদেশ সময়: ২২৫৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২৩
টিআর/এফআর