ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, ৭৫ সালের পর তারা সেই কথা বলতেও ভয় পেতেন। মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের একে একে হত্যা করা হয়।
তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা যারা চাকরি করতেন, চাকরি থেকে তাদের বিতাড়িত করেছে, তাদের অপমান করেছে, এমনকি কেউ মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হলে তারা চাকরিও পেত না। তারা এমন এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। এদেশের ইতিহাসকেও বিকৃত করে দেওয়া হয়েছিল। এটি হলো সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক। আমাদের চেষ্টা থাকবে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম যাতে তালিকায় থাকে।
বুধবার (২৫ জানুয়ারি) সংসদ অধিবেশনের প্রশ্নোত্তর পর্বে আওয়ামী লীগের সদস্য এ কে এম রহমতউল্লাহর এক সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অবৈধভাবে যারা ক্ষমতা দখল শুরু করে, সংবিধান লঙ্ঘন করে জিয়াউর রহমান নিজেকেই নিজে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে ক্ষমতা দখল করে, যুদ্ধাপরাধী যাদের বিচার শুরু হয়েছিল, যাদের অনেকেই তখন গ্রেফতার ও বন্দি ছিল, তারা তাদের মুক্ত করে দেয়। তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। শুধু তাই নয়, সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ এবং ৩৮ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে তাদের রাজনীতি করার সুযোগ এবং ভোটের অধিকার দেয়, উপদেষ্টা বানায়, মন্ত্রী বানায়।
তিনি বলেন, পরে আমরা দেখি খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের ক্যাবিনেটে স্থান দেয়, মন্ত্রী বানায়। এভাবে যুদ্ধাপরাধীদের প্রশ্রয় দেওয়া গোটা জাতির জন্য কলঙ্কজনক। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যারা জিয়ার সঙ্গে হাত মেলাতে রাজি ছিলেন না, তাদের বাদ দিয়ে অপমান করা, তাদের নাম বাদ দেওয়া এবং যারা মুক্তিযোদ্ধা নয়, তাদেরও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল এটা ঠিক। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়েছে, ইতোমধ্যেই পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে।
সরকারপ্রধান বলেন, যখন প্রথমবার সরকারে আসি, তখন রেড বুকে যে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ছিল, সেগুলোসহ অন্য যারা মুক্তিযোদ্ধা, তাদের আমরা সার্টিফিকেট দেওয়া শুরু করি। আমার মনে আছে, আমি ৭২ হাজারের মতো সার্টিফিকেট সই করে দিয়েছিলাম, আমি নিজের হাতে সই করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে সেই সার্টিফিকেট বাতিল ঘোষণা করে। অর্থাৎ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান তারা দিতে চায়নি।
তিনি বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। এই যুদ্ধ পরিচালনা করার সময় কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়ির যে মুরব্বি, তাকে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান বা মেম্বার করে রেখেছে, কিন্তু বাড়ির ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, তাদের অস্ত্র রাখতে দিয়েছে, মহিলারা রান্না করে খাইয়েছে। যেজন্য জাতির পিতা একটি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু যারা গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ধর্ষণ করেছিল, তাদের তিনি ক্ষমা করেননি, তাদের তিনি বিচার করেছিলেন এবং বিচারের আওতায় এনেছিলেন। কিন্তু ৭৫ এর পর সবকিছু পাল্টে যায়। মনে হয় যেন মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধ করে অপরাধ করেছেন। যারা স্বাধীনতাবিরোধী, তারাই ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছে। তবে বর্তমানে আর সে অবস্থা নেই।
জাতীয় পার্টির এমপি পীর ফজলুর রহমানের আরেক সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মূলত ৭৫ পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করা শুরু হয়। যারা জাতির পিতাকে হত্যা করেছিল এবং যারা এর পরে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিল, তাদের এই ইতিহাস বিকৃতি ধারাবাহিকভাবে ২১ বছর ধরে চলতে থাকে।
তিনি বলেন, যারা সত্যটাকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকতে চেয়েছিল, তারাই আজ ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে চলে গেছে। সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে, সত্য অনেক কঠিন, সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। আর বিচার! প্রাকৃতিকভাবে তার বিচার হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পরে বাংলাদেশকে ইতিহাস বিকৃতি থেকে থেকে মুক্তি দেয়। ইতিহাস যারা বিকৃত করেছে, আজ ইতিহাস তাদের বিচার করে ফেলেছে।
তিনি আরও বলেন, আমি যদি ৯৬ এর আগে যাই, কাকে ছেড়ে কাকে বিচার করব? এ সময় যারা সত্যি কথাটাও জানতেন, তারাও কিন্তু এই মিথ্যার ওপরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই হলো দুর্ভাগ্য। রেডিও টেলিভিশন থেকে পত্রিকা, কেউও তো বাদ যায়নি। খুব স্বল্পসংখ্যক মানুষ কিন্তু এর প্রতিবাদ করেছিল। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না, মিথ্যা দিয়ে সত্যকে ঢেকে রাখা যায় না। যারা ইতিহাস বিকৃত করেছিল তাদের চরিত্র মানুষের কাছে প্রকাশ পেয়েছে, কত জঘন্য কাজ তারা করে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ দেশের ইতিহাস শুধু উদ্ভাসিত হয়নি, দেশের মানুষ, বিদেশিরা, এমনকি নতুন প্রজন্ম এ ইতিহাস জানার সুযোগ পাচ্ছে। আমাদের যে সংগ্রাম ও স্বাধীনতা অর্জন তা আজ স্বীকৃত। এটাকে আজ আর কেউ বিকৃত করতে পারবে না। সম্ভবও না। শুধু তাই না জাতির পিতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ যেসব রিপোর্ট করেছিল, সেগুলো কিন্তু আমি ১৪ খণ্ডে বই আকারে প্রকাশ করেছি। ১১ খণ্ড ইতিমধ্যে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে, বাকি তিনটি খণ্ড আমার কাছে আছে, যা আমি পরীক্ষা নিরীক্ষা করছি, এডিট করছি। এর মধ্য থেকে ধারাবাহিকভাবে বঙ্গবন্ধুর যে সংগ্রামী জীবন, এদেশের মানুষের শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষের অধিকার আইনের জন্য যে সংগ্রাম, তার ইতিহাস কিন্তু এখানে বিধৃত হয়েছে। শুধু তাই না, বঙ্গবন্ধুর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, নয়াচীন- প্রতিটি বইয়ে কিন্তু তার সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস পাওয়া যায়। আরও একটি বই নিয়ে আমি কাজ করছি, যা অচিরেই প্রকাশিত হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০২৩
এসকে/আরএইচ