ঢাকা: দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী কিংবা দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের সঙ্গে পীর হাবিবুর রহমানের সম্পর্ক ছিল পরমাত্মীয়ের মতো। হৃদ্যতার বন্ধনে সবাইকে জড়িয়ে নেওয়া ছিল তার সহজাত প্রবৃত্তি।
রোববার (৫ ফেব্রুয়ারি) ছিল পীর হাবিবুর রহমানের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। কীর্তিমান এ সাংবাদিকরে স্মরণে জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরি হলে উপস্থিত হন তার পরিবারের সদস্য, সুহৃদ এবং সহকর্মীরা।
পীর হাবিবুর রহমানের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে স্বরণ সভায় বাংলাদেশ প্রতিদিন সিনিয়র রির্পোটার রফিকুল ইসলাম রনির সঞ্চালনায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক আবু তাহের।
পীর হাবিবের সন্তান ব্যারিষ্টার আহনাফ ফাহমিন অন্তর বলেন, দেখতে দেখতে এক বছর কেটে গেলো। বলতে গেলে অনেক কথাই বলা যায় লিখতে গেলে অনেক কিছুই লেখা যায়। বাবাকে কেউ সাংবাদিক হিসেবে দেখেন কেউ লেখক হিসেবে দেখেন। বাবাকে আমি পৃথিবীর অন্যতম সেরা বাবা হিসেবে দেখি। তিনি কোনো কিছুর কমতি রাখেননি। বাইরে যেমন সরল ছিলেন বাসায় ও তেমন সরল ছিলেন। বড় হওয়ার পর বাবার কাছ থেকে দেশের রাজনীতি নিয়ে অনেক কিছু শেখার সুযোগ পেয়েছি।
ক্লাসের সহপাঠী ও পূর্বপশ্বিম সম্পাদক এবিএম জাকিরুল হক টিটন বলেন, পীর হাবিবকে নিয়ে বলা আমার জন্য অনেক কষ্টের। ১৯৮৩ সাল থেকে রাবির পাশাপাশি হলে আমরা থাকতাম। দিনে আমাদের দেখা না হলেও রাতে আমাদের দেখা হতো। ঢাকা আসার পর থেকেও উত্তরায় আমরা পাশাপাশি থাকতাম। তার সবকিছু আমার সঙ্গে শেয়ার করতো। আমার বাসার নিচে এসে জোর করে আমাকে বাসা থেকে আড্ডা দেওয়ার জন্য বের করে নিয়ে যেতো। আড্ডা দিতো। সে লেখা ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করতে পারতো না। তার সঙ্গে আড্ডাগুলো জ্ঞানমূলক আড্ডা হয়ে থাকতো।
সিনিয়র সাংবাদিক তানজির আহমেদ চৌধুরি সিদ্দীকি বলেন, ৪০ বছর ধরে তার সঙ্গে আমার সর্ম্পক। ক্যাম্পাস জীবনে তাকে আমরা চিনতাম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে। ঢাকা আসার পর দেখি তার পুরোপুরি বিপরীত রূপ। সে লেখালেখি করতো। ওর লেখালেখি এত জ্ঞানমূলক ছিলো তা আমাকে খুব আলোড়িত করে। ক্যাম্পাস ভিত্তিক আড্ডায় সে ছিলো আমাদের মধ্যমনি। যে কোনো ধরনের আলোচনায় সে কথা বলার অধিকার রাখতো।
বাংলাদেশে প্রতিদিন উপ-সম্পাদক মাহমুদ হাসান বলেন, পীর হাবিবের গল্প শেষ হওয়ার নয়। এমন আবেগী মানুষ দেশপ্রেমের মানুষ ভালোবাসার মানুষ আমার জীবনে কম এসেছে। তাকে তার বন্ধুরা হাবিব নামে বললেও আমরা পীর নামে বলতাম। তিনি তার লেখনিতে দেশবাসীর কল্যাণে লিখতেন। তিনি ছিলেন সত্য প্রকাশে আপোষহীন। কোনো কিছু গোপন না করে সব প্রকাশ করতেন। তিনি কখনো ভোল পাল্টাননি আখের গোছানোর জন্য নিজেকে জলাঞ্জলি দেননি। সত্য ও ন্যাযের পক্ষে তিনি ছিলেন অনড়।
সিনিয়র সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম রতন বলেন, এক সময় আমরা যুগান্তরে পাশাপাশি কাজ করেছি। সম্পাদক গোলাম সারওয়ার পীর হাবিবকে নিয়ে বিভিন্ন সম্পাদকীয় লেখাতেন। তখন তিনি হাতে লিখতেন। তিনি যতদিন যুগান্তরে কাজ করেছেন ততদিন তাকে দিয়ে বিশেষ এসাইনমেন্ট করানো হতো। তখন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক ছিলো তা এখনকার রির্পোটারের মধ্যে নেই।
কুষ্টিয়া-১ আসনের সংসদ সদস্য সোহরাব জাহান বাদশাহ বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পীর হাবিব সাংবাদিক হিসেবে ছিলেন না। তখন তিনি লেখালিখি করতেন। সে অত্যন্ত উদ্দীপক মানুষ ছিলেন। তাকে কখনো বেয়াদবি করতে দেখিনি। তিনি রাজনীতি সচেতন অমায়িক মানুষ ছিলেন। সিনিয়রদের সঙ্গেও তার বিশেষ সর্ম্পক ছিলো। তিনি সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলতেন। তিনি মূলধারার সাংবাদিকতা চর্চা করতেন।
পীর হাবিবুর রহমানের ভাই পীর ফজলুর রহমান মিজবাহ বলেন, আমাদের ৮ ভাইয়ের পরিবার ছিলো। আমি আর হাবিব ভাই পিঠাপিঠি ছিলাম। আমরা প্রাচুর্যের মধ্যে বড় না হলেও আমাদের অন্তরঙ্গেও কমতি ছিলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে সিট পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি হাবিব ভাইয়ের রুমে ছিলাম। হাবিব ভাই যখন ঢাকায় সাংবাদিতা শুরু করেছে তখন সংগ্রামের জীবন ছিলো। সকালে রিপোটিং এ বের হয়ে যেতেন রাতে বাসায় ফিরতেন। রাতে শাহবাগে রাবির সাবেক শির্ক্ষাথীদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। সেখানে আমাকে নিয়ে যেতেন। জনসমাবেশ থেকে শুরু করে আমি সব জায়গায় কথা বলতে পারি। কিন্তু হাবিব ভাইকে নিয়ে কথা বলতে পারি না। তিনি কলামিস্ট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। সে নিজেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। কাউকে পরোয়া করে চলেন নাই। সেজন্য জীবনে অনেক সংগ্রাম করেছেন।
গাইবান্ধা-১ আসনের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ব্যরিষ্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, দুইবার পীর হাবিবের সঙ্গে দেখা হয়েছে। আমাদের সমাজে তার মতো নিরপেক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। পীর হাবিব সব কিছুর ঊর্ধ্বে লিখতেন। তার লেখায় উৎসাহমূলক নির্দেশনা থাকতো।
একাত্তর টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল হক বাবু বলেন, পীর হাবিব আমার রাজনৈতিক সহকর্মী ছিল। পীর হাবিবের মতো অনর্গল লেখক, সাবলীল লেখক আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটানে লিখে ফেলতে পারতো। সে রাজনীতিতেও অত্যন্ত পরিস্কার ছিল। বঙ্গবন্ধু কণ্যার জন্য জীবনের শেষ পর্যন্ত কাজ করে যেতে চেয়েছিল সে!
আবেগ অপ্লুত কণ্ঠে পীর হাবিবকে স্মরণ করেন তারই একান্তজন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম। তিনি বলেন, পীর হাবিব ছিলেন স্বকীয় ও সব্যসাচী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। চারপাশে বিচরণকারী প্রত্যেকটি মানুষকেই আপন করে নেওয়া ছিল তার অনন্য বৈশিষ্ট। লেখক হিসেবে বিভিন্ন বিষয়বস্তুর উপর তার পান্ডিত্য ছিল অনবদ্য। তার সূদূর প্রসারি পরিকল্পনা আমরা আমাদের কর্মস্থল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে প্রতিনিয়ত সাফল্যমণ্ডিত করেছে।
পরম বন্ধুকে স্মরণ করে তিনি বলেন, পীর হাবিবের শূন্যতা আমি প্রতিনিয়ত অনুভব করি। আমাদের কর্মস্থলে প্রতিনিয়ত তার শূন্যতা বিরাজ করে।
পীর হাবিবের স্ত্রী ডায়না নাজনিন বলেন, এতো মানুষ, এতো স্মরণসভা, সবাই ওকে নিয়ে এতো কথা বলে, ও এতো উদার মনের মানুষ ছিল, আমি অবাক হয়ে যায়। হাঁটি-চলি, কাজ করি, রান্না করি, তবুও এই সবকিছুর মধ্যেও ওকে খুঁজে ফিরি।
মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, আমাদের সম্পর্ক তিন ধরনের। সাংবাদিকতায় বন্ধুত্বের মতো। রাজনৈতি দিক থেকে কাছাকাছি। আবার পারিবারিকভাবেও আমরা কাছের। আমাদের সময়ের মধ্যে পীর হাবিব ছিল সবথেকে স্বচ্ছল; অর্থাৎ তার লেখনি, শব্দ, বিশ্লেষণ সব ছিল অসাধারণ। গনমুখী সাংবাদিকতার যে ধারা, তার একমাত্র প্রাণপুরুষ ছিল সে। রিপোর্টার থেকে কলামিস্ট এখন আমরা আর দেখছি না, অথচ এটাই আমাদের প্রয়োজন এবং পীর হাবিবুর রহমান তার উদাহরণ। সে আমাদের তরুণদের জন্য পথপ্রদর্শক।
আয়োজনে পীর হাবিবুর রহমানকে নিয়ে তার বন্ধু আত্মীয়-স্বজন মহলের বিভিন্ন ব্যক্তি, সাংবাদিক নেতারা বিভিন্ন কথা বলেন। তার প্রতিশ্রুতিবদ্ধতাকে স্মরণ করেন স্বজনরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০২৩
এইচএমএস/এসএ