ঢাকা, সোমবার, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ মে ২০২৪, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ফোন করলেই গাঁজা-বাবা নিয়ে বাড়ি যায় কারবারিরা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৪৪ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০২৩
ফোন করলেই গাঁজা-বাবা নিয়ে বাড়ি যায় কারবারিরা

ঢাকা: মদ, গাঁজা, ইয়াবা, ফেন্সিডিল, বিয়ার, আইস- বর্তমানে সারা দেশ জুড়ে চল চলছে এসব মাদকের। বাংলাদেশ তৈরি বা উৎপাদন না হলেও এসব মাদক সেবনকারীদের পছন্দের শীর্ষে।

নিষিদ্ধ এসব পণ্য সহজলভ্য, হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। আগে যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণে কেনাকাটা করতে সেবীদের সমস্যা হতো। কিন্তু এখন হয় না। মোবাইলে ফোন করলেই কারবারিরা বাড়ি নিয়ে আসে।

মোবাইল নম্বর তো বটেই, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রুপ খুলে তার মাধ্যমে চলে বেচাকেনা। সরবরাহকারী থেকে খরিদদার, বিভিন্ন নামে মদ, গাঁজা, ইয়াবা, ফেন্সিডিল, বিয়ার, আইস বেচা-কেনা করেন। মাদকের সবচেয়ে বেশি নাম ব্যবহার হয় গাঁজার- পট, সবজি, স্টিক। হালুয়া, ফান্টা নাম ব্যবহৃত হয় সাধারণত আইস ও ফেনসিডিল বেচা কেনায়। বাবা, ট্রেন, চাক্কা, ঢালাই নাম ব্যবহার হয় ইয়াবার ক্ষেত্রে।

দেশে প্রতিদিনই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক-গ্রেফতার হয় বহু মাদক কারবারি, মাদকসেবী; চোরাকারবারী। তবুও থেকে নেই নেশা বেচাকেনা। চাহিদা এত পরিমাণে বেড়েছে, দেশ ছেয়ে গেছে মাদকের কালো মেঘে।

রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ জেলাসহ দেশের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় গড়ে উঠছে মাদকের আখড়া। আগে এসব আখড়া বস্তি, রেললাইন, পাড়ার অন্ধকার গলি অথবা মাঠে থাকলেও এখন চলে এসেছে ঘরে ঘরে। কখন কোন বাসায় মাদকের কেনা-বেচা চলছে বোঝা দায়। এতে যুব সমাজ ধ্বংসের দিকে আরও বেশি ধাবিত হচ্ছে।

মাদকের কারণে ঘটছে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাত আনুমানিক ১২টার দিকে তেজগাঁও থানাধীন পানি ভবন সংলগ্ন ফুটপাথে পূর্ব পরিচিত রনির ও দিনমজুর ফারুক আড্ডা দিচ্ছিলেন। তার দুদিন আগে (২২ ফেব্রুয়ারি) জেল থেকে ছাড়া পান তাদের বন্ধু সাব্বির ওরফে সিটু সাব্বির। তিনি ছাড়া পেয়ে এ দুদিনে রাজধানীর বনানী থেকে ১২টি মোবাইল ছিনতাই করেন।

পরে এসব মোবাইল বিক্রি করে মোটা টাকা পাওয়ার সম্ভাবনায় উদযাপন করতে বার থেকে মদ কিনে আনেন। এরপর রনি, বিজয় ও ফারুকের সঙ্গে মদপান করেন সাব্বির। তিনি পরিমাণে একটু বেশি পান করেন। এ সময় ফারুকের সঙ্গে অন্যান্যদের পূর্ব ঘটনা ও ছিনতাইকৃত মোবাইল বিক্রি নিয়ে তর্ক ও গালাগালি হয় তাদের মধ্যে। পরে সাব্বির নিজের কাছে থাকা ধারালো অস্ত্র দিয়ে ফারুককে আঘাত করেন। এ ঘটনায় ফারুকের মৃত্যু হয়। তার আগে ফারুককে নিয়ে হাসপাতালে যায় বন্ধু বিজয়। মৃত্যুর খবর পেয়ে পড়ে তিনি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান।

এ ঘটনায় মো. সাদ্দাম হোসেন সাব্বির ওরফে সিটু সাব্বির ওরফে সাগর (২৩), মো. রনি (২৬) ও মো. বিজয়কে (৩৪) গ্রেফতারও করে তেজগাঁও থানা পুলিশ।

এ বিষয়ে তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হক বলেন, গ্রেফতারদের সঙ্গে নিহত ফারুকের পূর্বশত্রুতা ছিল। সেই আক্রোশ থেকে সাব্বির ও তার সহযোগীরা কৌশলে হত্যার ঘটনাটি ঘটায়। ঘটনার আগে চিহ্নিত অপরাধী সাব্বির অনেক বেশি মদ পান করে ফেলেছিলেন।

তিনি জানান, তেজগাঁও ও হাতিরঝিল থানায় সাব্বিরের বিরুদ্ধে অস্ত্র, দস্যুতা, মাদক ও দস্যুতা চেষ্টার অপরাধে সাতটি মামলা রয়েছে। ১ বছর ধরে জেলে থাকার পর ফারুককে হত্যার দুদিন আগে তিনি ছাড়া পেয়েছিলেন।

মাদকও আসছে, কারবারিরা আটকও হচ্ছে

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বলছে, যেসব কারবারিকে ধরা হচ্ছে, তারা সবাই বিভিন্নভাবে মাদক সরবরাহ করে। আগে তারা যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করতো, এতে তাদের ধরা সহজ ছিল। প্রতিনিয়ত মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করলেও ধরা সহজ। কিন্তু এখন ফেসবুক মেসেঞ্জার, হোয়াটঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন কলিং ফিচারাউজড অ্যাপের মাধ্যমে তারা মাদকের চালান করে। ফোনে অর্ডার পেলে তারা বিভিন্ন কৌশলে গ্রাহকদের হাতে মাদক পৌঁছে দেয়।

বহু আসামি তাদের এ ধরন সম্পর্কে স্বীকার করেছে। এমনকি আটক-গ্রেফতার হওয়া মাদকসেবীরাও এ পদ্ধতির কথা জানিয়েছেন। এতে অপরাধী ধরা কিছুটা কঠিন হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো প্রচণ্ড তৎপর রয়েছে।

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বনানী থানাধীন মহাখালী টিবি গেটের সামনে রাতে এক অভিযানে ৭২ লিটার বিদেশি মদ ও ১৬৯ লিটার বিয়ারসহ মাদক কারবারি মো. সবুর উদ্দিনকে (৫০) গ্রেফতার করে র‌্যাব-১। অভিযানে মাদক পরিবহনে ব্যবহৃত একটি প্রাইভেটকার জব্দ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সবুর জানান, তিনি অনেক দিন ধরে বিভিন্ন কৌশলে ভিন্ন ভিন্ন যানবাহনে করে পুলিশ-র‌্যাব-ডিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে বিদেশি মদ ও বিয়ারসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য বনানী থানা এলাকাসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি ও সরবরাহ করছিলেন।

২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন দনিয়া এলাকায় এক অভিযানে ৬০ কেজি গাঁজাসহ আব্দুর রশিদ মামুন (৪০) নামে এক কারবারিকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১০। তার কাছ থেকে পাওয়া গাঁজার আনুমানিক বাজারমূল্য ১৮ লাখ টাকা।

র‌্যাব জানায়, আব্দুর রশিদ মামুন পেশায় ট্রাক চালক। অধিক লাভের আশায় তিনি মাদক কারবারি চক্রের সঙ্গে জড়িত হন। দেশের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকায় থেকে গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য সংগ্রহ করে সেগুলো কৌশলে ঢাকায় নিয়ে আসতেন। এজন্য তিনি ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহন ব্যবহার করতেন। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকার মাদক কারবারিদের কাছে পাইকারি গাঁজা বিক্রি ও সরবরাহ করতেন তিনি।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৪টার দিকে উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকা থেকে ৬৮০০ পিস ইয়াবাসহ এনামুল হক ও অপু মিয়া নামে দুই কারবারিকে গ্রেফতার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা উত্তরা বিভাগ। গ্রেফতার এনামুল ও অপু দুজনই উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের জামির আলী মার্কেটসহ উত্তরা ৫ ও ১০ নম্বর সেক্টর, রানাভোলা এলাকায় ইয়াবা বিক্রি ও সরবরাহ করে আসছিল।

ডিএমপি গোয়েন্দা উত্তরা বিভাগের উত্তরা জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) বদরুজ্জামান জিল্লু বলেন, মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা পুলিশের অভিযান চলমান। সমাজকে মাদকমুক্ত করতে ও কারবারিদের আইনের আওতায় আনতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের নীতি জিরো টলারেন্স। অভিযানের মাধ্যমে আমরা প্রতিনয়িত মাদক কারবারিদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনছি। মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি না হলে এটি নির্মূল করা কঠিন। আমরা যেমন চেষ্টা করছি; দেশের নাগরিকদেরও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিৎ।

বাংলাদেশ সময়: ০১৪৪ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০২৩
এসজেএ/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।