রাজবাড়ী: বাংলাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদনের দিক দিয়ে রাজবাড়ী জেলার অবস্থান তৃতীয়। দেশে উৎপাদিত মোট পেঁয়াজের ১৪ শতাংশ এখানে উৎপাদন হয়।
তবে জেলার কালুখালী, বালিয়াকান্দি ও পাংশা উপজেলায় পেঁয়াজের চাষাবাদ বেশি। এ জেলায় মুড়িকাটা ও হালি পেঁয়াজের আবাদ করেন চাষিরা। এবারে এসব এলাকায় মাঠের পর মাঠ হালি পেঁয়াজের আবাদ করা হয়েছে।
চলতি মৌসুমে রাজবাড়ী জেলায় পেঁয়াজ চাষে বাম্পার ফলনের আশা করছে কৃষি বিভাগ। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ২০২২-২৩ অর্থ বছরে কৃষি বিভাগের লক্ষমাত্রা অর্জিত হওয়ার পথে। এ বছর রাজবাড়ীতে ৩৪ হাজার ৯১০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে যা গত বছরের চেয়ে ৪৫ হেক্টর বেশি। চাষাবাদ বেশি হওয়ায় উৎপাদনের হার বৃদ্ধি পেয়েছে এ জেলায়।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, রাজবাড়ী জেলার সদরে ২৬ হাজার ৬৪ হেক্টর, কালুখালী উপজেলায় ৯ হাজার ৩৫০ হেক্টর, বালিয়াকান্দি উপজেলায় ১১ হাজার ৩৪০ হেক্টর, পাংশা উপজেলায় ৯ হাজার ৩০০ হেক্টর এবং গোয়ালন্দ উপজেলায় ২ হাজার ২৫৬ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করেছেন চাষিরা। এ বছর রাজবাড়ী জেলায় সাড়ে ৪ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রতিদিন কাক ডাকা ভোর থেকে উঠে দিনব্যাপী মাঠে পরিশ্রম করছেন কৃষকরা। তবে, চলতি মৌসুমে অতিরিক্ত দামে পেঁয়াজের বীজ ক্রয়, জমি প্রস্তুত, জমিতে সেচ দিতে জ্বালানি তেলের অতিরিক্ত দাম ও শ্রমিকের অধিক মজুরি দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
পেঁয়াজ চাষিরা জানান, বাজারে পেঁয়াজের দাম কম। চাষে যে পরিমান খরচ হচ্ছে তাতে করে পেঁয়াজে লাভের চেয়ে লোকসানের সম্ভাবনা বেশি। আর ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ না করা গেলে আমাদের লোকসান আরও বাড়বে।
সম্প্রতি মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে বিক্রি করে লোকসান গুনেছেন চাষিরা। মাঠ পর্যায়ের চাষিরা পাইকারদের কাছে প্রতি মণ মুড়িকাটা পেঁয়াজ আকার ভেদে ৬০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি করেছেন। এতে ব্যাপক লোকসানে পড়তে হয়েছে তাদের। তাই এবার হালি পেঁয়াজ মান ভেদে ১ হাজার টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা মূল্য চাইছেন চাষিরা। স্থানীয় পাইকাররা রাজবাড়ীর বিভিন্ন হাট বাজার থেকে পেঁয়াজ কিনে ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে বিক্রি করেন।
সরেজমিনে রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার বহরপুর ইউনিয়নের পাটুরিয়ার মাঠে গিয়ে দেখা যায়, একরের পর একর জমিতে শুধু পেঁয়াজের চাষ হচ্ছে। এ অঞ্চলের অধিকাংশ চাষি হালি পেঁয়াজ চাষ করছেন।
কথা হয় পেঁয়াজ চাষী মাধব দাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের এখানে ২২ শতাংশ জমিতে ১ পাকি। আমি বর্তমানে ৭ পাকি জমিতে হালি পেঁয়াজের চাষ করছি। কদিন আগে এই জমিতেই মুড়িকাটা পেঁয়াজের চাষ করেছিলাম। প্রতি মণ মুড়িকাটা পেঁয়াজ ৮০০ টাকা করে বিক্রি করেছি। এতে আমার লোকসান হয়েছে। তাই আশা করছি চৈত্র মাসে হালি পেঁয়াজ উঠলে ভালো দাম পাবো। প্রতি মণ হালি পেঁয়াজ ১ হাজার ৫০০ টাকা দাম পেলে আমাদের কিছুটা লাভ হবে।
আরেক পেঁয়াজ চাষি মহিউদ্দিন সেখ বলেন, আমি ৩ পাখি জমিতে হালি পেঁয়াজের চাষ করছি। আমাদের রাজবাড়ী জেলার পেঁয়াজের সুনাম দেশ জুড়ে। তবে ভরা মৌসুমে যদি অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানী হয় তাহলে আমরা দেশের কৃষকরা দাম পাবো না। চরম লোকসানের মুখে পড়বো।
পেঁয়াজ চাষি প্রিয় নাথ দাস বলেন, আমি ১৪ পাখি জমিতে হালি পেঁয়াজের চাষ করছি। ১ পাকি জমিতে পেঁয়াজ চাষে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আশা করছি প্রতি পাকিতে ৩০ মণ পেঁয়াজ উৎপাদন হবে। তবে চলতি মৌসুমে অতিরিক্ত দামে পেঁয়াজের বীজ ক্রয়, জমি প্রস্তুত, জমিতে সেচ দিতে জ্বালানি তেলের অতিরিক্ত দাম ও শ্রমিকের মজুরি বেশি দিতে আমরা জমির মালিকরা হিমশিম খাচ্ছি। আমরা হালি পেঁয়াজ মণ প্রতি দেড় হাজার টাকা দাম আশা করছি।
রাজবাড়ী জেলার কালুখালী উপজেলার রতনদিয়া ইউনিয়নের বহর কালুখালীর ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পেঁয়াজ চাষি মো. চুন্নু বিশ্বাস বলেন, আমাদের এখানে ২৬ শতাংশে ১ পাখি জমি। এ বছর আমি আড়াই পাকি জমিতে হালি পেঁয়াজের চাষ করেছি। শতাংশে ১ মণ করে পেঁয়াজ আশা করছি। আমাদের হিসেবে ১ শতাংশ জমিতে দেড় মণ করে পেঁয়াজ হওয়ার কথা।
কৃষক রবিউল ইসলাম জানান, কালুখালীতে পেঁয়াজের ব্যাপক চাষাবাদ হয়। আমি ২ পাকি জমিতে হালি পেঁয়াজের চাষ করেছি। এখন ক্ষেতের যত্ন নিচ্ছি। প্রতি মণ পেঁয়াজ ১ হাজার ৫০০ টাকা দাম আশা করছি। তবে ভরা মৌসুমে ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি হলে আমরা লোকসানে পড়বো।
আরেক পেঁয়াজ চাষি শহর আলী বলেন, পৌষ মাসে হালি পেঁয়াজ লাগিয়ে চৌত্র মাসে উঠেছে। পাইকাররা আমাদের কাছ থেকে পেঁয়াজ কিনে ট্রাকে বোঝাই করে ঢাকায় নিয়ে যান। এ বছর পেঁয়াজ বিক্রির টাকা দিয়ে বাড়িতে একটা গাভী কিনবো।
রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার জঙ্গল ইউনিয়নের বড় বাজারের একটি পেঁয়াজের আড়ৎ হচ্ছে মেসার্স লস্কর ট্রেডার্স। এর আড়ৎদার মো. ফিরোজ লঙ্কর জানান, সম্প্রতি প্রতি মণ মুড়িকাটা পেঁয়াজ সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা মণ প্রতি ক্রয় করা হয়েছে। হালি পেঁয়াজের ফলন ভালো হবে বলে আশা করি।
বালিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারী মো. যাইদুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, রাজবাড়ী জেলা পেঁয়াজ চাষে বিখ্যাত। আমরা নিয়মিত এ অঞ্চলের চাষিদের পেঁয়াজ চাষাবাদে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। মাঠ পর্যায়ে প্রতিটি চাষিদের খোঁজ খবর রাখি। এ বছর আবহাওয়া ভালো থাকায় হালি পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করছি।
বালিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি হচ্ছে একটা কৃষি সমৃদ্ধ উপজেলা। এ উপজেলায় মোট আবাদী জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৫৯৪ হেক্টর। বালিয়াকান্দি উপজেলায় চলতি মৌসুমে ১১ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের চাষাবাদ হয়েছে। বালিয়াকান্দিতে কৃষকরা পেঁয়াজের যেসব জাত চাষ করেন তার মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত বারি পেঁয়াজ ৪, ৬, হাইব্রিড জাত কিং রয়েছে। চলতি মৌসুমে বালিয়াকান্দি উপজেলায় ১১ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষ হয়েছে। এর সঙ্গে প্রায় ৩৬ হাজার কৃষক পরিবার জড়িত। আমরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও মাঠ পর্যায়ে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিকভাবে কৃষকদের নতুন চাষাবাদের প্রযুক্তি সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিয়ে থাকি।
তিনি আরও বলেন, পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমরা নিবিড়ভাবে কাজ করছি। এ বছর রাজবাড়ীতে ৩৪ হাজার ৯১০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে যা গত বছরের চেয়ে বেশি। চাষাবাদ বেশি হওয়ায় উৎপাদনের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছর রাজবাড়ীতে সাড়ে ৪ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৮ ঘণ্টা, মার্চ ০৪, ২০২৩
এফআর