ঢাকা: প্রতি বছরই ঝড়, বন্যা, খড়া, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় পরিণত হয়েছে। তবে পূর্বাভাস ও পূর্বপ্রস্তুতির কারণে দুর্যোগের ক্ষতি কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে।
শনিবার (৪ মার্চ) দুপুরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ইস্টওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেডের (ইডব্লিউএমজিএল) কনফারেন্স রুমে জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস-২০২৩ উপলক্ষে ‘স্মার্ট বাংলাদেশের প্রত্যয় দুর্যোগ প্রস্তুতি সবসময়’ শিরোনামে এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে যৌথভাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় দুর্যোগ মন্ত্রণালয় এবং মিডিয়া একসঙ্গে কাজ করার সব সময় প্রয়োজন। পৃথিবীর উন্নত সব দেশ দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হিমশিম খায়। এসব দুর্যোগে তারা তখন অসহায়ত্ববোধ করে। সেখানে বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতা অনেক বেশি। তুরস্ক ও সিরিয়াতে যে ভূমিকম্প হলো তারা কিন্তু তা মোকাবিলা করতে পারেনি। কিন্তু তাদের সক্ষমতা বাংলাদেশের থেকে অনেক বেশি। সে হিসেবে বাংলাদেশের পূর্বপ্রস্তুতি অনেক বেশি থাকা দরকার।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) প্রফেসর মাহবুবা নাসরিন বলেন, বঙ্গবন্ধুর সময় থেকে মূলত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শুরু হয়। এরপর থেকে বাংলাদেশের মানুষ দুর্যোগ নিয়ে ভাবতে শুরু করে। আমরা যদি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চাই তাহলে দুর্যোগের পূর্ববর্তী সতর্কবার্তার ক্ষেত্রে আমাদের উন্নত প্রযুক্তির নিয়ে অনেক কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে দেশে এখন অনেক ঝটিকা বন্যা দেখা হচ্ছে। আমাদের সে বিষয়ে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। বজ্রপাত থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষায় বজ্রপাত ডিটেক্টর দেশের আরও অনেক জায়গায় স্থাপন করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ঘুর্ণিঝড় মোকাবিলায় আমরা সার্বিকভাবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের রোল মডেল। এর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার সক্ষমতা আমাদের কাছে। তবে ভূমিকম্প বাংলাদেশের জন্য নতুন এক দুর্যোগ। এটাকে আমরা কমাতে পারবো যদি আমাদের পূর্বপ্রস্তুতি থাকে। ভূমিকম্প মানুষ মারে না। বিল্ডিং ধসের মাধ্যমে মানুষ বেশি মারা যায়। তাই আমাদের বিল্ডিং করার সময় ভালোভাবে ডিজাইন করে করতে হবে। ভূমিকম্পের সোর্সগুলো নিয়ে আমাদের বেশি করে গবেষণা করতে হবে। ভূমিকম্পের সোর্স কত দূরে সেই ক্যালকুলেশন করে বিল্ডিং। যদিও বাংলাদেশ ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা থেকে অনেক দূরে। তারপরও এ বিষয়ে অনেক সতর্ক থাকতে হবে। তাহলে ক্ষয়ক্ষতির হার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মহাসচিব (অতিরিক্ত সচিব) মো. মিজানুর রহমান বলেন, ভূমিকম্প মোকাবিলায় আমরা জাপানকে রোলমডেল হিসেবে অনুসরণ করতে পারি। মানসম্মত বিল্ডিং করলে ভূমিকম্প কিছুই করতে পারবে না। বর্তমান সরকারের অনেক প্রকল্প আছে, যা আট মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল। বন্যা ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের প্রস্তুতি থাকলেও ভূমিকম্পের বিষয়ে তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই। পাশাপাশি অগ্নিকাণ্ডের সময় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয় ইন্টেরিয়রের ফলস সিলিংয়ের জন্য। তাই ভবনের ফলস সিলিং বন্ধ করার জন্য সরকারের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ঘোষণা দেবার পরামর্শ দেন তিনি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান বলেন, কোনো দুর্যোগের পূর্বাভাসই হচ্ছে স্মার্ট প্রস্তুতি। তাই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে দ্রুত ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে উন্নত করতে হবে। পাশাপাশি দুর্যোগে কখনো আতঙ্কিত না হয়ে সরকারের দেওয়া বিল্ডিং কোড মেনে চলার আহ্বান জানান তিনি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি ক্যাপ্টেন (অব.) এবি তাজুল ইসলাম বলেন, প্রকৃতির প্রতি আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে। বর্তমানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের থেকে বেশি মানবসৃষ্ট দুর্যোগের পরিমাণই বেশি। প্রকৃতির সঙ্গে খারাপ করলে সে আমাদের সঙ্গে বৈরী আচরণ করবে। এটাই স্বাভাবিক। তাই এখন থেকেই এসব মানবসৃষ্ট দুর্যোগগুলো বন্ধ না করলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে।
গোলটেবিল বৈঠকে দুর্যোগের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্য তুলে ধরা হয়, সেগুলো হলো—
১) আপন পর্যবেক্ষণ ও দুর্যোগের পূর্বাভাস প্রদান।
২) দুর্যোগের আগাম সতর্কবার্তা প্রচার।
৩) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে স্থানীয়করণ।
৪) প্রশিক্ষণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ।
৫) সুযোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণ।
৬) বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ।
৭) বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ।
৮) মুজিবকিল্লা নির্মাণ।
৯) সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ।
১০) গ্রামীণ রাস্তাসমূহ টেকসইকরণে এইচবিবিকরণ।
১১) জেলা ত্রাণ গুদাম কাম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তথ্যকেন্দ্র নির্মাণ।
১২) দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বর্ধিতকরণ প্রকল্প।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রধান বার্তা সম্পাদক কামাল মাহমুদের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী ড. এনামুর রহমান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি ক্যাপ্টেন (অব.) এবি তাজুল ইসলাম, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো কামরুল হাসান এনডিসি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মহাসচিব (অতিরিক্ত সচিব) মো. মিজানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি (শিক্ষা) প্রফেসর মাহবুবা নাসরিন, বন্যাপ্রবণ ও নদী ভাঙ্গন এলাকায় বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ (৩য় পর্যায়) প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মোহাম্মদ তাসারফ হোসেন ফরাজী, ভূমিকম্প ও অন্যান্য দুর্যোগে অনুসন্ধান উদ্ধার অভিযান পরিচালনা ও জরুরি যোগাযোগের জন্য যন্ত্রপাতি সংগ্রহ (৩য় পর্যায়) প্রকল্প পরিচালক কাজী শফিকুল আলম, স্ট্রেংদেনিং অব দি মিনিস্ট্রি অব ডিসাস্টার ম্যানেজমেন্ট রিলিফ প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক ড. মো মনিরুজ্জামান, ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট এনহাঞ্চমেন্ট প্রজেক্টের প্রকল্প পরিচালক সুব্রত পাল চৌধুরী প্রমুখ।
বাংলাদেশ সময়: ২০১৪ ঘণ্টা, মার্চ ০৪, ২০২৩
ইএসএস/এমজেএফ