জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি): শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির আইনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, প্রতি বছর সিন্ডিকেটে অনুমোদনের জন্য বার্ষিক বাজেট পেশ করবেন ট্রেজারার। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর নিয়োগ পাওয়া সব ট্রেজারার এ আইন মেনেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সাবেক ট্রেজারারসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিষয়টি আইন বহির্ভূত। বাজেট উপস্থাপনে ট্রেজারারের অদক্ষতা ও অর্থ পরিচালকের ওপর নির্ভরতাকে দায়ী করছেন তারা। এর আগে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এক রায়ে উল্লেখ করেছে, এই ট্রেজারার ‘প্রশাসনিকভাবে অদক্ষ’। তবে বাজেট পেশে আইন না মানার বিষয়টি নজরে এসেছে ও সামনের বাজেট ট্রেজারারই পেশ করবেন বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৫ এর ১২ (৫) ধারায় বলা আছে, সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে ট্রেজারার বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি ও বিনিয়োগ পরিচালনা করবেন। এবং তিনি বার্ষিক বাজেট ও হিসাব-বিবরণী পেশ করার জন্য সিন্ডিকেটের নিকট দায়ী থাকবেন।
তবে ২০২০-২১, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ (সর্বশেষ বাজেট ১৪৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা) অর্থবছরের বাজেট অনুমোদনের জন্য সিন্ডিকেটে পেশ করেন অর্থ ও হিসাব দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. কাজী নাসির উদ্দীন। তিনটি বাজেটের শেষে তিনি উল্লেখ করেন, বাজেট প্রণয়নে ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. ইমদাদুল হকের বাস্তবভিত্তিক প্রায়োগিক মতামত এবং ট্রেজারার অধ্যাপক ড. কামালউদ্দিন আহমদের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজস্ব বিচার বিবেচনার নিরিখে ফান্ড ব্যবস্থাপনার নির্দেশনার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এছাড়া বাজেট টিমের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। একই সঙ্গে বাজেট অনুমোদনের জন্য বিনীতভাবে পেশ করছি।
সুতরাং গত তিনটি বাজেটই পেশ করেছেন অর্থ পরিচালক। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিয়োগের তিন বছরে একটি বাজেটও নিজে পেশ করেননি ইংরেজির অধ্যাপক থেকে ট্রেজারার পদে নিয়োজিত ড. কামালউদ্দিন আহমদ।
বিশ্ববিদ্যালয়টির বিগত অর্থবছরগুলোর বাজেটের নথি ঘেঁটে দেখা যায়, আগের সব ট্রেজারারই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন মেনে বাজেট পেশ করেছেন। যেমন- ২০০৭-০৮, ২০০৮-০৯ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন তৎকালীন ট্রেজারার অধ্যাপক ড. আবু হোসেন সিদ্দিক। ২০১০-১১, ২০১১-১২ অর্থবছরে বাজেট পেশ করেন তৎকালীন ট্রেজারার অধ্যাপক ড. মো. শওকত জাহাঙ্গীর। একইভাবে সর্বশেষ সাবেক ট্রেজারার অধ্যাপক ড. সেলিম ভূঁইয়া ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ৮টি বাজেট নিজেই সিন্ডিকেটে পেশ করেন। বাজেটের নিচে তাদের সই আছে।
এর আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকের টেন্ডার নিয়ে ঠিকাদারদের মধ্যে ঝামেলা বাঁধলে মীমাংসার জন্য বিষয়টি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে যায়। শুনানি শেষে গত বছরের ২০ জুলাই রায়ে মন্ত্রণালয়ও বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার ‘প্রশাসনিকভাবে অদক্ষ’। বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডারের টেক কমিটি থেকে তাকেসহ ৪ জনকে বাদ দেওয়ার সুপারিশও করা হয়। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ পরিচালক ড. নাসির উদ্দীনের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির তথ্য ইতোমধ্যে বের হয়েছে। তার মেয়াদও অনেক আগে শেষ হয়েছে। বিতর্কিত এই ব্যক্তিকে সরিয়ে আরেকজনকে নিয়োগের কথা একাধিকবার উঠেছে শিক্ষক সমিতি থেকেও। তবে ট্রেজারার নির্ভরতায় স্বপদে নির্ভার রয়েছেন নাসির উদ্দীন।
বাজেটের বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. নাসির উদ্দীন বলেন, আমি অর্থ কমিটির সদস্য সচিব। ট্রেজারার স্যার আমাকে বলেছেন বাজেট তৈরি করতে। সেটা সিন্ডিকেটে উপস্থাপন করেছেন স্যার। ’ এদিকে ট্রেজারারের স্থানে বাজেট অনুমোদনে অর্থ পরিচালকের নিজে পেশ করার বিষয়টি আইন বহির্ভূত কিনা- প্রশ্ন করা হলে কোনো জবাব মেলেনি।
অর্থ পরিচালক দিয়ে বাজেট উপস্থাপনের বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ট্রেজারার অধ্যাপক ড. কামালউদ্দিন আহমদ বলেন, এটা কোনো সমস্যা না। অর্থ পরিচালককে আমি অ্যাসাইন করে দিয়েছি। বাজেট আমি অনুমোদন দিয়েছি। আরেকজন উপস্থাপন করতে পারেন।
এ সময় আইনে বাজেট উপস্থাপন একমাত্র ট্রেজারার করবেন- জানানো হলে কামালউদ্দিন আহমদ বলেন, না না, করি তো আমিই। কন্ট্রিবিউট করি। আর এটা তো সংসদীয় অধিবেশন না যে, অর্থমন্ত্রীকেই বাজেট উপস্থাপন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো কিছু নেই। এটা বৈধ, নাকি অবৈধ আমি জেনে পরে বলব।
এ বিষয়ে জবির সাবেক ট্রেজারার অধ্যাপক ড. শওকত জাহাঙ্গীর বলেন, আইনে লেখাই আছে, ট্রেজারার বাজেট উপস্থাপন করবেন। সিন্ডিকেটে তা অনুমোদিত হবে। সেটার সঙ্গে বর্তমান বাজেট উপস্থাপন মিলছে না। যিনি বাজেট পেশ করবেন তিনিই কাগজে স্বাক্ষর করবেন। না হলে আইনে বলা হতো, ট্রেজারারের পক্ষে অর্থ কমিটির যে কেউ বাজেট পেশ করবেন। লিখিতভাবে অর্থ পরিচালক বাজেট পেশ করল আর সেটা ট্রেজারার সিন্ডিকেটে পড়ে শোনাল, কেমন হয়ে গেল না? এরআগে কখনো এমন হয়নি।
সাবেক ট্রেজারার অধ্যাপক ড. সেলিম ভূঁইয়া বলেন, আমি দুই মেয়াদে ৮ বছর ট্রেজারার ছিলাম। ৮টি বাজেটই নিজে করেছি। আইনেই বলা আছে, বাজেট পেশে ট্রেজারার দায়বদ্ধ থাকবেন। অন্য কারো দিয়ে বাজেট পেশ করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
সার্বিক বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইমদাদুল হক বলেন, বিষয়টি আমারও নজরে এসেছে। গত ৩ বাজেট নিজে কেন করেননি ট্রেজারার বলতে পারবেন। তবে সামনের বাজেট তিনি নিজেই করবেন আশা করছি। আইন ও নিয়মে যেটা আছে সামনে থেকে সেটাই হবে।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর চার বছরের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ড. কামালউদ্দিন আহমদকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। চলতি বছরের ২৭ নভেম্বর কামালউদ্দিন আহমদের ট্রেজারার পদে মেয়াদ শেষ হবে। অর্থাৎ এই মেয়াদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ বাজেট পেশ করার সুযোগ পাবেন তিনি। সর্বশেষ বাজেটটি আইন মেনে নিজে পেশ করবেন, নাকি ফের অর্থ পরিচালকের ওপর নির্ভার করে থাকবেন, সেটাই প্রশ্ন।
বাংলাদেশ সময়ছ ১৫০২ ঘণ্টা, মার্চ ৬, ২০২৩
এমজে