ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর জীর্ণদশা, মহাপরিকল্পনাতেও মিলছে না সুফল

তানভীর আহমেদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৭ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০২৩
ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর জীর্ণদশা, মহাপরিকল্পনাতেও মিলছে না সুফল

ঢাকা: দূষণ, দখল ও ভরাটের কারণে রাজধানীর ঢাকার চারপাশের নদীগুলো পরিণত হয়েছে খাল ও নর্দমায়। জনস্বার্থে এসব নদী দখলমুক্ত ও প্রবহমান করতে গ্রহণ করা হয় একটি মহাপরিকল্পনা।

তবে দীর্ঘ একযুগ আগে সেই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন কাজ শুরু হলেও এখনও মেলেনি এর আশানুরূপ সুফল।  

এসব নদীর বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন, নদীর দুই পাড়ের সাধারণ মানুষ এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের সঙ্গে কথা বলে মিলেছে এমনই চিত্র।

বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, সরকার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে না পারলে ঢাকা শহরের চারপাশের নদীগুলো ধীরে ধীরে সংকুচিত হতে হতে অদূর ভবিষ্যতে বিলীন হয়ে যাবে। যেমন- মানচিত্র থেকে ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে টঙ্গি খাল (টঙ্গি নদী)। সেই সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জাতীয় অর্থনীতির ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, ২০০৯ সালের জুন মাসে দেওয়া উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে সরকার রাজধানীর চারদিকে বৃত্তাকারে প্রবাহিত বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদী রক্ষার উদ্যোগ নেয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে এই পাঁচ নদীকে অবৈধ দখলমুক্ত করার পাশাপাশি দূষণরোধ এবং প্রবহমান করার লক্ষ্যে গ্রহণ করা হয় ২০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা।

সূত্র জানায়, এসব নদীর শাখা নদী ও খালের তৎকালীন পরিস্থিতি এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের চলমান প্রকল্পসমূহ পর্যালোচনা করে মহাপরিকল্পনাটি তৈরি করা হয়; যা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী- তিন ধাপে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। মহাপরিকল্পনায় প্রথম ১০ বছরের স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী এবং শেষ ১০ বছরে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের কথা বলা হয়।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্রে জানা গেছে, নদীরক্ষার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীর দুই তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে ১০ হাজার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও ৩০০ একর তীরভূমি উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত তীরভূমিতে ৮৪৮ দশমিক ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা তীরভূমিতে পিলার স্থাপন, তীর রক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ (২য় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পের কাজ চলমান।

সূত্র মতে, এ প্রকল্পের আওতায় নদীর দুই পাড়ে ৫২ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, তীররক্ষা বাঁধ, ভরাট হওয়া মাটি খনন, ১০০টি আরসিসি সিঁড়ি, এক কিলোমিটার কি-ওয়াল, সেতু ও রেলিং নির্মাণ, ৪০৯টি বসার বেঞ্চ, ১০ হাজার ৮২০টি সীমানা পিলার, তিনটি ইকোপার্ক, ১৯টি জেটি, ছয়টি লং বুম এস্কেভেটর ক্রয় ও নদীর তীরে বনায়ন করা হবে।  

ইতোমধ্যে ৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, তিন হাজার স্থায়ী সীমানা পিলার স্থাপন, ছয়টি লং বুম এস্কেভেটর, এক হাজার বৃক্ষরোপণ শেষ হয়েছে। এছাড়া ওয়াকওয়ে, জেটি ও ইকোপার্ক নির্মাণসহ অন্যান্য কাজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। ২০২৩ সালের জুনে প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হবে বলে বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানিয়েছে।

তবে নদী রক্ষায় যত প্রতিশ্রুতিই দেয়া হোক না কেনো, আশানুরূপ সাফল্য এখনও আসেনি। বরং এ পর্যন্ত যে অর্জন তা হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা। তারা বলছেন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের উদ্যোগে ৬৪ জেলায় অবৈধ দখলদারের তালিকা করা হয়েছে। সেই তালিকা জেলায় জেলায় টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ভিত্তিতে অনেক এলাকায় উচ্ছেদ অভিযানও চালানো হয়েছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি। কেননা, মোট দখলদারের ৬৮ শতাংশকেই উচ্ছেদ করতে পারেনি সরকার। দখলমুক্ত করার পর আবার অনেক জমি দখল করে নিয়েছেন প্রভাবশালীরা। এসব অবৈধ দখলদারের তালিকায় ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দখলদারও রয়েছেন।

প্রসঙ্গত, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের উদ্যোগে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ৬৪ জেলায় ৫৭ হাজার ৩৯০ অবৈধ দখলদারের তালিকা তৈরি ও তা প্রকাশ করা হয়। দখলদারদের মধ্যে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার দাবি, ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ ১৮ হাজার ৫৭৯ জন বা ৩২ শতাংশ অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়। করোনা মহামারি শুরুর পর অবশ্য এতে ভাটা পড়ে।  

তবে, নদী রক্ষার দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে নদী দখলদারদের যোগসাজশ রয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

তাদের মধ্যে অনৈতিক অর্থ লেনদেনের অভিযোগের কথাও জোরেশোরে উচ্চারিত হয়। এ কারণে উচ্ছেদ অভিযানে প্রত্যাশিত সাফল্য আসছে না।

পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক, বিশিষ্ট পরিবেশবিদ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, ঢাকার চারদিকের নদীগুলো অবৈধ দখল ও দূষণমুক্ত করে আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে উচ্চ আদালতের রায় যেমন যুগান্তকরী ঘটনা ছিল, তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনাও ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়।

কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, খোদ সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের সঙ্গেই নদীখেকো অবৈধ দখলদারদের গভীর সখ্য রয়েছে। এ কারণে কোনো অভিযানেই আশানরূপ সাফল্য আসছে না।

ঢাকার চারদিকের নদীগুলো উদ্ধার ও রক্ষার কাজে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করে এই পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলী বলেন, সরকার এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে না পারলে নদীগুলো ধীরে ধীরে সংকুচিত হতে হতে অদূর ভবিষ্যতে বিলীন হয়ে যাবে। যেমন, মানচিত্র থেকে ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে টঙ্গি খাল (টঙ্গি নদী)।  

একই সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জাতীয় অর্থনীতির ওপরও এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেন ম. ইনামুল হক।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৯ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০২৩
টিএ/এনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।