ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

গলায় আইডি কার্ড-পরনে অ্যাপ্রোন, ডাক্তার সেজে বাসায় ঢুকে চুরি 

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩১ ঘণ্টা, এপ্রিল ৬, ২০২৩
গলায় আইডি কার্ড-পরনে অ্যাপ্রোন, ডাক্তার সেজে বাসায় ঢুকে চুরি 

ঢাকা: অভিজাত এলাকায় কার বাসায় রোগী আছে নেওয়া হতো আগাম তথ্য। খুব সকালে সেসব বাসার কেউ অফিস যেতেন বা কেউ স্কুল-কলেজে যেতেন কি-না জেনে নিতেন আগে থেকেই।

সকালে বাসা থেকে কারো বের হওয়ার সময়টিকে বেছে নেওয়া হতো।

এরপর কৌশলে মুখে মাস্ক, গলায় ভুয়া আইডি কার্ড ঝুলিয়ে অ্যাপ্রোন পরে ঢুকে পড়তেন সে বাসায়। মাত্র ২-৩ মিনিটের মধ্যে মোবাইল-ল্যাপটপসহ মূল্যবান সামগ্রী চুরি করে সটকে পড়তেন এ ভুয়া ডাক্তার।

আফসানা আক্তার এশা ওরফে মিম (২২) নামে সে ভুয়া ডাক্তার একাই বাসায় প্রবেশ করে চুরি করে নিরাপদে বেরিয়ে যেতেন। দীর্ঘ প্রায় ২ বছর ধরে রাজধানীর গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি ও উত্তরা এলাকায় অভিনব পন্থায় চুরি করে আসছিলেন তিনি।

সম্প্রতি গুলশান-১ এর একটি বাসায় এমন একটি চুরির তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে এ চাঞ্চল্যকর তথ্য। গুলশানের বিভিন্ন এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে মিমকে শনাক্ত করে গ্রেফতার করে গুলশান থানা পুলিশ।

বুধবার (৫ এপ্রিল) গুলশান-২ নম্বর বনানীগামী সড়কে পুলিশ চেকপোস্ট থেকে আফসানা আক্তার এশা ওরফে মিমকে আটক করা হয়। পরে তার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে এ চোর চক্রের আরও ৫ গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতার বাকিরা হলেন- তন্ময় বিশ্বাস (৩০), স্বপন শেখ (৪৫), নুরুল ইসলাম (২৭), কলিম উদ্দিন কালু ওরফে কলিউল্লাহ (৪০) ও মোখলেছুর রহমান (৫১)।

পুলিশ জানায়, মিম এ চোর চক্রের দলনেতা আর তন্ময় তার বন্ধু। বাকিদের সহায়তায় দীর্ঘদিন ধরে মিম এ চুরি চালিয়ে আসছিল। গ্রেফতারের পর মিমের লালবাগের বাসা থেকে ৬টি ল্যাপটপ, ১০টি মোবাইল ফোন ও ২টি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়।

গুলশান-১ এর একটি বাসায় চুরির বর্ণনায় পুলিশ জানায়, ওই বাড়ির মালিক জায়েদুল ভুঁইয়ার মা অসুস্থ এবং প্রায়ই বাসায় ফিজিওথেরাপি দিতে ডাক্তার আসতেন। ঘটনার দিন সকাল ৭টার দিকে মিম চিকিৎসক সেজে ওই বাসার গেটে আসেন। দারোয়ান জানতে চাইলে মিমি বলেন, জায়েদুল সাহেবের মাকে ফিজিওথেরাপি দিতে সকালেই তাকে আসতে বলেছেন। দারোয়ানও এতে সন্দেহ না করে ভেতরে প্রবেশ করতে দেন।

এরমধ্যে ৭টার দিকে বাসার মালিক জায়েদুলের মেয়েও স্কুলের উদ্দেশে বেরিয়ে যায়। মেয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার পর ভেতর থেকে পুনরায় গেট বন্ধ করার যে মাঝখানে ২-৩ মিনিটের ব্যবধান, এরমধ্যেই মিম বাসায় ঢুকে ল্যাপটপ-মোবাইল হাতিয়ে বের হয়ে যান।

মিমের বিরুদ্ধে গুলশান থানাসহ বিভিন্ন থানায় মোট ১৪টি মামলা ও ২টি সাজা গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। এর আগেও মিম গুলশান, নিউমার্কেট, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও থানায় ১ বার করে মোট ৪ বার এবং মুখলেছুর রহমান তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় ১ বার গ্রেফতার হয়েছিলেন। জামিনে বেরিয়ে তারা আবার অভিনব এ চুরিতে জড়িয়ে পড়েন।

ভুক্তভোগী গুলশান-১ এর বাসিন্দা জায়েদুল ভুঁইয়া বলেন, আমার মা অসুস্থ ও সকাল ৭টার দিকে আমার মেয়ে স্কুলে যায়। গত ২৫ জানুয়ারি ৭টার পর ওই মেয়েটি দারোয়ানের কাছে এসে আমার নাম বলে আমার মাকে ফিজিওথেরাপি দিতে ডেকেছি বলে জানায়। দারোয়ানও অ্যাপ্রোন পরা ওই মেয়েটিকে কোনো সন্দেহ ছাড়াই ভেতরে যেতে দেন।

আমার মেয়ে ৭টা ১০ মিনিটের দিকে স্কুলের উদ্দেশে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় কাজের মহিলাকে দরজা বন্ধ করার জন্য বলে। কিন্তু সে বের হওয়া এবং কাজের মহিলার দরজা বন্ধ করার মাঝখানে যে ২-৩ মিনিট সময় এরমধ্যে ওই মেয়েটি বাসায় ঢুকে ল্যাপটপ-মোবাইল চুরি করে বের হয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, পরে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আমরা ওই মেয়েটিকে ছাড়া কাউকে দেখিনি। সে একাই সুনির্দিষ্ট প্ল্যান করে সবকিছু জেনে আমার বাসায় এসেছে। পরে শুনেছি গুলশানের আরও ৮-১০ টি বাড়িতে সে এমনভাবে চুরি করেছে।

ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. আ. আহাদ জানান, এ চক্রের দলনেত্রী মিম অভিনব কায়দায় দীর্ঘদিন ধরে চুরি করে আসছিলেন। সে সাধারণত অভিজাত এলাকার কোনো বাসায় রোগী আছে কি-না খোঁজ নিতেন। সেসব বাসার লোকজন কখন অফিস বা স্কুলের উদ্দেশে বেরিয়ে যায় সে সময়টাকেই চুরির জন্য বেছে নিতেন। এ সময়ের মধ্যেই কৌশলে ২-৩ মিনিটের মধ্যে মোবাইল-ল্যাপটপসহ মূল্যবান জিনিস যা সামনে যা পড়ে তা নিয়েই বেরিয়ে যায়।

সে সাধারণত একটি অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে দেখতো কোন ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। যেসব ফ্ল্যাটের দরজা খোলা পেতো সেসব ফ্ল্যাটেই সে ঢুকতো। কখনো কোন বাসায় ঢুকে কারো সামনে পড়ে গেলে কৌশলে অন্য বাসায় এসেছিল ভুল করে ঢুকে পড়েছে বলে বেরিয়ে যেতো।

ডিসি বলেন, একটি মেয়ে ডাক্তারের পোশাক পরা, আইডিকার্ড ঝুলানো তাই কেউ সন্দেহ করতোনা। বাসার দারোয়ানকেও এমনভাবে যে বাসায় রোগী আছে সে বাসার মালিকের নাম বলে যেতে বলতেন দারোয়ানও এ মেয়েকে সন্দেহ না করেই ভেতরে যেতে দিতেন।

সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ডিসি বলেন, মিম প্রায়ই গুলশান এলাকায় বিভিন্ন বাসা টার্গেট করে ভেতরে ঢুকতেন। আমাদের জানামতে সে ১৪টি মামলার আসামি। তাকেসহ আমরা ৬ জনকে আটক করেছি। তাকে গ্রেফতারের খবরে হয়তো আরও অনেক ভুক্তভোগী আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।

মিম প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে একেক সময় একেক ধরনের তথ্য দিয়েছে। তার পড়াশোনা বা অন্য কোন পেশার বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। প্রায় ২ বছর ধরে মিম এ পেশায় জড়িত ও সে এ চক্রের দলনেত্রী। তার সঙ্গে আরও কেউ জড়িত আছে কি-না রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বিস্তারিত জানা যাবে।

নগরবাসীর উদ্দেশে ডিসি আহাদ বলেন, আমরা এসব চোরদের থেকে সাবধান থাকবো। দারোয়ানকে কেউ এসে বললেই পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে যেন প্রবেশ করতে না দেয় সেটি সবাই নিশ্চিত করবো।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩১ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৬, ২০২৩
পিএম/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।