ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

মশার কয়েল বা সিগারেটের আগুন থেকে পুড়েছে বঙ্গবাজার: ডিএসসিসি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩০৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০২৩
মশার কয়েল বা সিগারেটের আগুন থেকে পুড়েছে বঙ্গবাজার: ডিএসসিসি

ঢাকা: বঙ্গবাজারে সংগঠিত অগ্নিকাণ্ডে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) গঠিত তদন্ত কমিটি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দাখিল করেছে। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৩ হাজার ৮৪৫ জন।

মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) বিকেলে কমিটির সভাপতি ও অঞ্চল-১ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মেরীনা নাজনীন এই প্রতিবেদন দাখিল করেন।

এ সময় ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান, কমিটির সদস্য প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আরিফুল হক, প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দীন, রমনা রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুহাম্মদ মামুনুল হক এবং সংরক্ষিত আসন-৫ এর কাউন্সিলর রোকসানা ইসলাম চামেলী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে মার্কেটের ছয়জন নিরাপত্তা প্রহরী ও একজন বিদ্যুৎমিস্ত্রির সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। সাক্ষ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের আদর্শ ইউনিটের তৃতীয় তলার আলমগীরের এমব্রয়ডারি টেইলার্স থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এই টেইলার্সের সরাসরি ওপরে অবস্থিত চতুর্থ তলায় আদর্শ মার্কেটের আটজন নিরাপত্তা প্রহরীর থাকার কক্ষ ছিল। আদর্শ ইউনিটের নিরাপত্তা প্রহরী বিল্লাল হোসেন (৬০) ঘটনার দিন ভোর আনুমানিক ৫টা ৪০ মিনিটে দায়িত্বরত অবস্থায় মার্কেট ও দোকানের লক সিস্টেম পরীক্ষা করতে গেলে চতুর্থ তলার নিরাপত্তা প্রহরীদের ঠিক নিচের তলায় অর্থাৎ তৃতীয় তলার আলমগীরের এমব্রয়ডারি টেইলার্সের তালা বন্ধ শাটারের নিচ থেকে আগুনের ধোঁয়া বের হতে দেখেন। তিনি তখন ‘আগুন আগুন’ বলে চিৎকার করলে চতুর্থ তলা থেকে নিরাপত্তা প্রহরী দেলোয়ার ও মার্কেটের বিদ্যুৎমিস্ত্রি মামুন ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন।

এরপর তারা তিনজন মিলে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইশার) দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। তাদের চিৎকার শুনে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মার্কেটের অপর বিদ্যুৎমিস্ত্রি হাবিবুর রহমান ও অন্য প্রহরীরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন এবং আগুন নেভানোর কাজে তাদের সহযোগিতা করেন। নিরাপত্তা প্রহরীরা আগুন লাগার সংবাদ ফায়ার সার্ভিসকে জানান এবং ঘটনার ১০ মিনিটের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনাস্থলে চলে আসে। তারা আগুন নেভানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। কিন্তু এর মধ্যেই আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় ও মার্কেটের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে।

তদন্ত কমিটি আগুন লাগার কারণ হিসেবে তিনটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কাজ করেছে। প্রথমত, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লেগেছে কিনা; দ্বিতীয়ত, এটি নাশকতা ছিল কি না; তৃতীয়ত, দুর্ঘটনা বা অন্য কারণে ঘটেছে কিনা?

কমিটির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেটের কাঠামোগত অবস্থান ও নির্মাণসামগ্রী বিবেচনায় ডিএসসিসি এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পর্যবেক্ষণে অগ্নিকাণ্ডের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। সে কারণে মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে দোকান মালিক, ভাড়াটিয়া, কর্মচারী, নিরাপত্তা প্রহরীসহ সবার জন্য বৈদ্যুতিক হিটার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, যে কোনো রান্নার চুলা, মশার কয়েল ব্যবহার বা ধূমপানের বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল। তারপরও শাটার তালাবন্ধ অবস্থায় একটি দোকানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে। দোকানটি সরাসরি নিরাপত্তা প্রহরীদের কক্ষের নিচে অবস্থিত। সাক্ষীদের তথ্যমতে, চতুর্থ তলার নিরাপত্তা প্রহরীদের কক্ষের মেঝে কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি, যাতে মাঝে মাঝে ফাঁকা বা গ্যাপ থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে মেঝের ফাঁকা দিয়ে দুটি কারণে আগুন লাগতে পারে।

এর একটি হচ্ছে—ওই কক্ষে অবস্থানকারী যে কোনো প্রহরীর ধূমপানের অভ্যাস থাকলে সেখান থেকে মেঝের ফাঁকা দিয়ে তৃতীয় তলায় আগুন যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অনেক সময় ধূমপায়ীরা সিগারেট/বিড়ি মেঝেতে ফেলে পা দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে।

জিজ্ঞাসাবাদে তদন্ত কমিটি জানতে পেরেছে, নিরাপত্তা প্রহরীদের একজন হোসেন পাটোয়ারীর সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস ছিল। সাক্ষ্যগ্রহণের সময় তিনি বলেন, ১৫-১৬ বছর আগে ধূমপান ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু অন্য প্রহরীদের থেকে জানা যায়, ধূমপানের অভ্যাসের জন্য এক বছর আগেও মার্কেট কমিটি তাকে সতর্ক করেছিল। ফলে এতে প্রমাণ হয়, হোসেন তার সাক্ষ্যে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন।

জানা গেছে হোসেন তার রাতের ডিউটি শেষে ইউনিফর্ম পরিবর্তনের জন্য প্রহরীদের কক্ষে যান, তারপর মসজিদে নামাজ পড়ে সেখানেই ঘুমিয়ে যান। সাহ্‌রি খাওয়ার পর যদি তিনি লুকিয়ে সিগারেট খেয়ে থাকেন ও চতুর্থ তলায় পোশাক পরিবর্তনের সময় সেটি পা দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করেন, তাহলে কাঠের তক্তার ফাকা অংশ দিয়ে তা সরাসরি তৃতীয় তলায় পড়ে আগুন লাগতে পারে।

আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে—তদন্ত কমিটির কাছে সাক্ষীদের ভাষ্যমতে বঙ্গবাজার মার্কেটে মশার উপদ্রব ছিল। যার কারণে নিরাপত্তা প্রহরীরা মশার কয়েল ব্যবহার করতে পারেন এবং সেই কয়েল থেকেও তৃতীয় তলার এমব্রয়ডারি টেইলার্সে আগুনের সূত্রপাত ঘটতে পারে।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ২ হাজার ৯৬১টি দোকান পুড়ে ছাই হয়েছে। এ ছাড়া মহানগর মার্কেটের ৭৯১টি, বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটের ৫৯টি এবং বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্সের ৩৪টি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তদন্ত কমিটির হিসাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এসব মার্কেটের অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ ১৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আর মালামালের ক্ষতির পরিমাণ ২৮৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের এ ঘটনায় ৩০৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

ভবিষ্যতে অগ্নিকাণ্ড এড়াতে তদন্ত কমিটি ১০টি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য সুপারিশগুলো হলো ডিএসসিসির আওতাধীন কোনো এলাকায় কাঠের/টিনের মার্কেট থাকা সমীচীন নয়। যদি থেকে থাকে, তা দ্রুত কংক্রিট বা পাকা করার ব্যবস্থা করতে হবে। ডিএসসিসি এলাকায় অবস্থিত মার্কেটগুলোতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। নিয়মিত উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের পরিদর্শন করে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সচল আছে কি না, যাচাই করে সনদ দিতে হবে। সেই সনদ দৃশ্যমান স্থানে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডে ওয়াটার রিজার্ভার থাকতে হবে এবং এটা থেকে পাইপের মাধ্যমে যুক্ত করে মার্কেটের চারটি স্থানে ওয়াটার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা রাখতে হবে। মার্কেটগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ, ভোল্ট ক্যাপাসিটি ও ব্যবহারের মধ্যে সামঞ্জস্য সঠিক বা পর্যাপ্ত রয়েছে কিনা, তা সব সময় পরীক্ষা করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। সিটি করপোরেশন অধিভুক্ত সব জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে ইত্যাদি।

বাংলাদেশ সময়: ২৩০৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০২৩ত
এইচএমএস/এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।