ঢাকা: দিনের বেলা রাস্তা-ঘাটে মোটরসাইকেল/গাড়ি চুরির জন্য টার্গেট করতো চক্রের একটি দল। এরপর পিছু পিছু গিয়ে রেকি করে ওই মোটরসাইকেল/গাড়ির অবস্থান, গ্যারেজ ও বাসা শনাক্ত করতো তারা।
শুধু তাই নয়, চোরাই মোটরসাইকেল/গাড়ি চক্রের গোপন গ্যারেজে নিয়ে গাড়ির রঙ, ইঞ্জিন নম্বর, চেসিস নম্বর ও রেজিষ্ট্রেশন নম্বর পরিবর্তন করতো। সেই সঙ্গে বিআরটিএর দালালের মাধ্যমে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে সেগুলো দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করতো চক্রটি।
চক্রের মূলহোতা সৈয়দ মাহামুদ হাসান (৩৭)। মূলত তার পরিকল্পনা অনুযায়ী সহযোগীরা মোটরসাইকেল/গাড়ি চুরি করতো বলেও জানিয়েছে র্যাব-৩।
শনিবার (৬ মে) দুপুরে রাজধানীর টিকাটুলিতে র্যাব-৩ এর কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গোয়েন্দা তৎপরতা এবং তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে রাজধানীর মিরপুর ও যশোর জেলার কোতয়ালী থানাধীন এলাকায় অভিযান চালিয়ে মোটরসাইকেল/গাড়ি চোর চক্রের মূলহোতা সৈয়দ মাহামুদ হাসান (৩৭) ও তার দুই সহযোগী মিরাজ হোসেন (৩২) ও মো. আল আমিনকে (৪৩) আটক করে র্যাব-৩। অভিযানে তাদের কাছ থেকে ১টি চোরাই মাইক্রোবাস এবং ১টি চোরাই মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়।
র্যাব-৩ সিও আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, গত ২৯ এপ্রিল গভীর রাতে রাজধানীর সবুজবাগ এলাকার বাসিন্দা ওমর ফারুকের বাসার গ্যারেজ থেকে ২টি ‘অ্যাপাচি-ফোর ভি’ মোটরসাইকেল তালা ভেঙে নিয়ে যায় চোর চক্রের সদস্যরা। পরদিন ভোরে মালিকরা তাদের মোটরসাইকেলগুলো খুঁজে না পেয়ে সবুজবাগ থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন।
বিষয়টি র্যাবের নজরদারিতে আসলে ঘটনাস্থল এ আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণ এবং গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি বড় চোরচক্রের সন্ধান পাওয়া যায়। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে চুরিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ইউনুসকে (৪০) শনাক্ত করা হয়। পরে গত ৩ মে চক্রের সদস্য ইউনুসকে আটক করে সবুজবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী শুক্রবার (৫ মে) রাতে যশোর জেলার অভয়নগর থানার ধর্মতলা এলাকা থেকে চক্রের মূলহোতা মাহামুদকে আটক করা হয়। পরে তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে সহযোগী মিরাজ হোসেন ও মো. আল আমিনকে আটক করা হয়। তাদের দুই জনের গ্রামের বাড়ি মাগুরা জেলায়।
আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, আটক ব্যক্তিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, এই চক্রটি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে কাজ করে। প্রথমত মাহামুদের নেতৃত্বে একদল মাঠপর্যায়ে মোটরসাইকেল/গাড়ি চুরির উদ্দেশ্যে টার্গেট করে। রেকির মাধ্যমে মোটরসাইকেল রাখার স্থান বা বাসা চিহ্নিত করে। পরে সময়-সুযোগ বুঝে তারা যন্ত্রপাতি নিয়ে রাতের আধারে টার্গেটকৃত বাসায় ঢুকে মোটরসাইকেল/গাড়ি চুরি করে পালিয়ে যায়। পরে কৌশলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে চোরাই মোটরসাইকেল নিয়ে তারা রাজধানী ছেড়ে দেশের কোনো দূরবর্তী জেলায় চলে যায়। সেখানে চক্রের অন্য সদস্যদের কাছে মোটরসাইকেল হস্তান্তরের পর তারা দ্রুত ওয়ার্কশপে নিয়ে মোটরসাইকেলের রঙ, ইঞ্জিন ও চেসিস নম্বর, নম্বর প্লেট ইত্যাদি পরিবর্তন করে ফেলে। পাশাপাশি তারা ওই মোটরসাইকেলের কিছু পার্টস পরিবর্তন বা সংযোজন করে দেয় যাতে করে প্রকৃত মালিক গাড়িটিকে সহজে চিনতে না পারে।
তিনি বলেন, মোটরসাইকেলের যন্ত্রপাতি পরিবর্তনের কাজ চলতে থাকার পাশাপাশি চক্রের আরেকটি দল বিআরটিএতে দালালদের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন পরিবর্তনের কার্যক্রম চালায়। তাদের এই কাজে বিআরটিএর এক দালালের নাম উঠে এসেছে, তার নাম সুজন।
তিনি আরও বলেন, আসামিরা জানিয়েছে এই সুজন চক্রের একজন অন্যতম মূলহোতা। তার মাধ্যমেই মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন নম্বর পরিবর্তন করে ভুয়া ট্যাক্স টোকেন, রোড পারমিট, ফিটনেস সনদ, ইন্স্যুরেন্স ইত্যাদি যাবতীয় কাগজপত্র তৈরি করা হয়।
এরপর মোটরসাইকেলটি চক্রের আরেকটি দলের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ওই চক্রের অন্যতম দুই সহযোগী আল আমিন এবং মিরাজের নেতৃত্বে সেই দলটি চোরাই মোটরসাইকেলের প্রকৃত মালিক সেজে বিভিন্ন প্রতারণামূলক পন্থা অবলম্বন করে সাধারণ মানুষের কাছে তা বিক্রি করে। এভাবেই আটক ব্যক্তিরা চক্রের অন্য সদস্যদের সঙ্গে মিলে দীর্ঘদিন ধরেি বিপুল সংখ্যক মোটরসাইকেল ও গাড়ি চুরি করে সেগুলো সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করেছে।
জিজ্ঞাসাবাদে আটক মাহামুদ জানান, তিনি অল্প পরিশ্রমে অধিক মুনাফার আশায় বিভিন্ন অনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের পথ বেছে নেন। ২০২২ সালের শুরুর দিক থেকে মোটরসাইকেল চোরচক্রের একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এ ধরনের আরও কয়েকটি চক্রের সঙ্গে মিলে একটি বড় সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এভাবেই চক্রটি রাজধানীসহ সারাদেশে তাদের চুরির কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, আটক আল-আমিন পেশায় রঙমিস্ত্রী। ওই পেশার আড়ালে চোরাই মোটরসাইকেল বিক্রির জন্য গ্রাহক সংগ্রহ করতেন। এছাড়া মিরাজ পেশায় গাড়িচালক। চক্রে তার কাজ ছিল চোরাই মোটরসাইকেল বিক্রির জন্য একস্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া।
আটক আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান এই র্যাব কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৪ ঘণ্টা, মে ০৫, ২০২৩
এসজেএ/এমএমজেড