ঢাকা, শনিবার, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

অস্ত্র জমা দিয়ে তারা বললেন, ‘আলোর পথের যাত্রী হয়ে সামাজিক স্বীকৃতি চাই’

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৫ ঘণ্টা, মে ২২, ২০২৩
অস্ত্র জমা দিয়ে তারা বললেন, ‘আলোর পথের যাত্রী হয়ে সামাজিক স্বীকৃতি চাই’ আত্মসমর্পণ হতে অনুষ্ঠানে বিভিন্ন চরমপন্থী সংগঠনের সক্রিয় তিন শতাধিক সদস্য

সিরাজগঞ্জ: র‌্যাবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা বেশ কয়েকটি চরমপন্থী সংগঠনের সক্রিয় তিন শতাধিক সদস্য ‘আলোর পথের যাত্রী’ হতে আত্মসমর্পণ করেছেন।

রোববার (২১ মে) দুপুরে সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায় র‌্যাব-১২ সদর দপ্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের হাতে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন তারা।

 

প্রায় ২১৬টি অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করলেন সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, মেহেরপুর কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী ও টাঙ্গাইল জেলার ৩১৬ জন চরমপন্থী সদস্য।

কথা হয় এসব চরমপন্থী সদস্যদের সঙ্গে। তারা বাংলানিউজকে বলেন, আদর্শের নামে এতদিন ভুল পথে ছিলাম আমরা। দুর্বিসহ ফেরারি জীবন ছিল। এক জেলার মানুষ অন্য জেলায় থাকতে হয়েছে। বাবা-মা স্ত্রী-সন্তানের খোঁজ-খবর রাখতে পারি নাই। তারাও প্রশাসনিক ও সামাজিক নানা হয়রানির শিকার হতো। এভাবে আর নয়, এবার আমরা অন্ধকারের জগত ছেড়ে আলোর পথে এসেছি। আলোর পথের যাত্রী হয়ে দেশের উন্নয়নে অংশ নিতে চাই। চাই সামাজিক স্বীকৃতি।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে পূর্ব বাংলা সর্বহারা দলের কেন্দ্রীয় এক সদস্য বলেন, আমরা যে জগতে বাস করেছি এটা ছিল অন্ধকার জগত। আমাদের স্বজন মারা গেলেও তাদের কবরে মাটি দিতে পারিনি। এই জগত থেকে সরে আসতে আজ প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই আত্মসমর্পণ করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমি আজ তাদের ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।

রুজভেল্ট নামে এক চরমপন্থী নেতা বলেন, আমরা সুস্থ জীবনে ফিরে আসছি। সরকার যেন মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়। সমাজ আমাদের ওইভাবে গ্রহণ করবে না। সরকার যেন আমাদের সংসার চালানোর মতো কর্মসংস্থান করে দেয়।

আত্মসমর্পণকারী চরমপন্থী দলের নেতা মোহাম্মদ সাধু বলেন, আমাদের পার্টির যেসব ভাই আজকের প্রোগ্রামে বাদ পড়েছে, তাদেরকে পরবর্তীতে যেন আত্মসমর্পণ করিয়ে আলোর পথে আনা হয়। আমাদের মামলা থেকে মুক্তি ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার দাবি জানাই। আমাদের দাবি বিভিন্ন সময়ে আমরা যে অপরাধ করিনি সেখানেও আমাদের ফাঁসানো হয়। এরকম মিথ্যা মামলা যেন আমাদের নামে আর না হয়।

রাজবাড়ী থেকে আসা এক অভিভাবক বলেন, ৪/৫ বছর ধরে তার ছেলে চরমপন্থী দলে নাম লিখিয়েছেন। আজকে ভুল বুঝে আত্মসমর্পণ করতে এসেছে।

নাজমা আক্তার নামে একজন চরমপন্থী সদস্যের স্ত্রী বলেন, আমার স্বামী দীর্ঘ ২০ বছর ধরে এই সর্বহারা পার্টিতে নাম দিয়েছে। টাঙ্গাইল জেলায় তিনি বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড করে বেড়াতেন। তিনি দীর্ঘদিন জেলে থাকায় আমি আমার ছেলেমেয়ে ও
শ্বশুড়-শাশুড়ি নিয়ে অনেক কষ্টে জীবনযাপন করেছি। এখন আমার স্বামী বুঝতে পেরেছেন এটা জীবন না। তিনি আত্মসমর্পণ করেছেন।

র‌্যাব সূত্র জানায়, ‘উদয়ের পথে’ নামে একটি পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে চরমপন্থী পরিবারের সদস্যদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে চরমপন্থী পরিবারের ৩০ জন নারী সদস্যকে স্বাবলম্বী করতে হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও মাছ চাষ, গরু বা মুরগির খামার, রিকশা, সেলাই মেশিন প্রদানের মাধ্যমে চরমপন্থী নেতা ও সদস্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করা হবে।

র‌্যাব-১২ অধিনায়ক অ্যাডিশনাল ডিআইজি মারুফ হোসেন বলেন, খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ ছাড়া ছোটখাট অপরাধগুলো সাধারণ ক্ষমার আওতায় আসবে এবং আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মামলাগুলো নিষ্পত্তি হবে। প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন তাদের যাতে মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা হয় এবং তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে সুশিক্ষায় পেয়ে দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে সেদিকে বিবেচনা রেখে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আত্মসমর্পণকারী চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে সব মামলা পর্যালোচনা করে সে অনুযায়ী তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। আজ আবার ৩১৫ চরমপন্থি আত্মসমর্পণ করায় আমরা সবাই আনন্দিত।  

তবে যারা আত্মসমর্পণ করবেন না তাদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে তিনি বলেন, যদি কেউ অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তাদের বিরুদ্ধে কঠিনতর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, তরুণ বয়সে একটি মহান আদর্শের কথা বলে মূলত অন্ধকারে প্রবেশ করানো হয়েছিল এসব যুবকদের। ধীরে ধীরে অপরাধ জগতের বাসিন্দা হয়ে খুন, গুম, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল তারা।

সত্তরের দশক থেকে মার্কস-লেলিন ও মাওবাদী আদর্শের নামে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি এম এল (লাল পতাকা), পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি (এমবিআরএম) ও পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি (জনযুদ্ধ)সহ ১৪টি আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠন তরুণ সমাজকে ভুল বুঝিয়ে দলে ভিড়িয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসে।  

এক সময় চরমপন্থী সংগঠনগুলোর দোর্দণ্ড প্রতাপে প্রত্যন্ত জনপদ সন্ত্রাস ও আতংকের রাজ্যে পরিণত হয়েছিল।  

অবশেষে ২০২০ সালে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জনপদকে চরমপন্থীদের আগ্রাসন থেকে রক্ষায় তাদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয় র‌্যাব।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৮ ঘণ্টা, মে ২২, ২০২৩
এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।