গাইবান্ধা: ব্রহ্মপুত্র নদে নাব্যতা সংকটের কারণে বালাসি-বাহাদুরাবাদ নৌ-রুটে টানা ৮ মাস ধরে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় গাদাগাদি করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছেন যাত্রীরা।
এদিকে বেশি লাভের আশায় ধারণ ক্ষমতার বেশী যাত্রী বহন করায় যে কোন সময় নৌকা ডুবির আশঙ্কা করছেন ভুক্তভোগীরা। সেই সঙ্গে আছে ছাদ খোলা নৌকায় রোদে পোড়ার কষ্ট। রোববার ( ৪ জুন) দুপুরে এমনই নিত্র চোখে পড়ে জেলার ফুলছড়ি উপজেলার বালাসি ঘাট এলাকায়।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ছোট ছোট নৌকায় যাত্রীরা গাদাগাদি করে ঝুঁকি নিয়ে ছুটে চলছেন নিজ নিজ গন্তব্যে। এসব নৌকায় নেই ছাউনি, নেই নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেকে পরবর্তী নৌকার জন্য নদীতীরে অপেক্ষা করছেন। ওপার থেকে যে সব নৌকা তীরে এসে ভিড়ছে সেগুলোরও একই অবস্থা।
ভুক্তভোগীরা জানান, জীবন-জীবিকার তাগিদেই ছুটে চলা। পানির গভীরতা কমে যাওয়ায় লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। কিন্তু বন্ধ নেই জীবন-জীবিকার আহ্বান। স্ ডাকে সাড়া দিতেই নৌকায় গাদাগাদি করে ঝুঁকি নিয়ে চলাচলে বাধ্য হচ্ছেন নারী, শিশুসহ সর্বস্তরের মানুষ। গুণতে হচ্ছে তুলনামূলক অনেক বেশি ভাড়া। সেই সঙ্গে নৌকার মাঝিরা অতিরিক্ত লাভের আশায় ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রী বহন করছেন। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচলে বাধ্য হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা।
তারা আরও জানান, বালাসি থেকে বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত জনপ্রতি ২৫০ টাকা ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। বেশি ভাড়া নেওয়া হলেও নৌকায় যাত্রী সুবিধা নেই। নেই যাত্রী ছাউনি কিংবা ছাতার ব্যবস্থা। রোদে পুড়ে যেতে হয়। এতে শিশু, বৃদ্ধ ও নারীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
রিভার স্টার লঞ্চের চালক খোকন মিয়া বলেন, নাব্যতা সংকটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে দীর্ঘ ৮ মাস হলো ঘাটে বসে অলস সময় পার করছেন।
তিনি জানান, একটি মাঝারি আকারের লঞ্চ নদীতে চলতে গেলে কমপক্ষে পানির গভীরতা ৬ ফুট হতে হয়। কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের বিভিন্ন স্থানে পানির গভীরতা তিন থেকে চার ফুট। এই অবস্থায় লঞ্চ চলাচল অসম্ভব। তবে পানির গভীরতা বাড়লে লঞ্চ চলাচল শুরু হবে।
বালাসিঘাটের ইজারাদার বাদল মিয়া জানান, লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় নৌকায় যাত্রীর চাপ বেড়েছে। এই রুটে প্রতিদিন ছোট-বড় ১৫-২০টি নৌকা চলাচল করে।
বালাসি-বাহাদুরাবাদ লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরিফ মিয়া বলেন, উদ্বোধনের পর থেকে প্রতিদিন বালাসিঘাট থেকে নিয়মিত তিনটি লঞ্চ চলাচল করত। প্রতিটি লঞ্চে ১৫০ জন যাত্রী ধারণের ক্ষমতা রয়েছে। যেতে সময় লাগত পৌনে দুই ঘণ্টা ও আসতে আড়াই ঘণ্টা। জনপ্রতি ভাড়া ১২০ টাকা থাকলেও তেলের দাম বাড়ায় তা ২০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু নাব্যতা সংকটের কারণে লঞ্চ চালানো যাচ্ছে না। লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক করতে বিআইডাব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষের কাছে ড্রেজার চাওয়া হয়েছে। নিয়মিত ড্রেজিং ছাড়া এ রুটে লঞ্চ চালানো সম্ভব নয়।
প্রসঙ্গত, ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৮ সালে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখঘাট এবং জামালপুর জেলার বাহাদুরাবাদ নৌরুট চালু করে। তখন এই অঞ্চলের ৮ জেলার মানুষ ট্রেনযোগে তিস্তামুখ ঘাট হয়ে ঢাকায় যেতেন। দূরত্ব তিন-চার ঘণ্টা কমেছিল।
এরপর ১৯৯০ সালে নদীর নাব্যতা সংকটে তিস্তামুখ ঘাট একই উপজেলার বালাসীতে স্থানান্তর করা হয়। এজন্য প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ত্রিমোহিনী থেকে বালাসি পর্যন্ত নতুন প্রায় ছয় কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হয়। তখন বালাসি-বাহাদুরাবাদ রুটের মাধ্যমে একইভাবে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু ছিল।
১৯৯৬ সাল থেকে নদীর নাব্যতা হ্রাসের কারণে বালাসি-বাহাদুরাবাদ রুটে রেলওয়ের ফেরি চলাচল বন্ধের উপক্রম হয়ে যায়। এর মধ্যে ১৯৯৮ সালের জুন মাসে যমুনা বহুমুখী সেতু চালু হয়। ফলে ২০০০ সাল থেকে এ রুটে রেলের ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকে প্রায় ২২ বছর ধরে বালাসি-বাহাদুরাবাদ রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল।
দীর্ঘ সময় পর গত বছরের ৯ এপ্রিল বালাসি-বাহাদুরাবাদ নৌরুটে লঞ্চ সার্ভিস চালু করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ)। এজন্য উভয় পাশে ১৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নৌ টার্মিনাল নির্মাণ করে। কিন্তু গাইবান্ধাবাসীর বহু প্রত্যাশিত লঞ্চ সার্ভিস চালু করা হলেও তা কাজে আসছে না।
বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, ৪ জুন ২০২৩
এমএমজেড