ঢাকা: দীর্ঘ সাড়ে ৩১ বছর কারাভোগের পর অবশেষে মুক্তি পেয়েছেন ২৬ জনের ফাঁসির দড়ি টানা আলোচিত ‘জল্লাদ’ শাহজাহান ভূঁইয়া।
রোববার (১৮ জুন) বেলা পৌনে ১২টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।
কারাগার থেকে বেরিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন শাহজাহান। কারা ফটক থেকে বের হওয়ার সময় তার মুখে হাসি থাকলেও গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার সময় বেশ কয়েকবার কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
এ সময় তিনি বলেন, দীর্ঘ দিন আমি কারাগারে ছিলাম। এ সময় আমি কারা কর্তৃপক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা পেয়েছি। তারা আমাকে যথেষ্ট আদর ও সম্মান করেছেন। কারাগারে আমি ভালো ছিলাম।
তিনি আরও বলেন, কারাগারে কয়েদি ও হাজতি এই দুই ধরনের মানুষ থাকে। হাজতি হলো যাদের সাজা হয়নি, মামলা বিচারাধীন। আর কয়েদি হলো সাজাপ্রাপ্ত আসামি৷ সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের কিছু কিছু কাজ দেওয়া হয় কারাগারে। আমি সাহসী ছিলাম, তাই আমাকে জল্লাদের কাজটি দেওয়া হয়েছিল। যাদের আমি ফাঁসি দিয়েছি আদালত তাদের সাজা দিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি তাদের ফাঁসি বহাল রেখেছেন। যেমন- বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, যুদ্ধাপরাধী, জেএমবি, এরশাদ শিকদার, মনির ফাঁসি আমি দিয়েছি। এখানে আমার কোনো ক্ষমতা বা অর্ডার নেই।
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দেওয়ার অনুভূতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই অনুভূতি আমার ভালোই লেগেছে। কারণ আমি যখন বাইরে ছিলাম, তখন স্বাধীনতার সংগ্রাম দেখেছি। তারা যেহেতু যুদ্ধাপরাধীর অভিযোগে দোষী হয়েছে, তাহলে আমার কোনো খারাপ লাগার কথা না।
তিনি আরও বলেন, আমি অপরাধ করেছি। সেজন্য জেলে এসেছি, সাজা ভোগ করেছি। আপনারা এখন আমার প্রতি মায়া দেখাচ্ছেন- লোকটা এত বছর জেল খেটেছে। আমার পেছনের দিকটা যদি আপনারা তাকান। তাহলে দেখবেন, আমি অতীতে কেমন ছিলাম। এখন আমি মায়ের গর্ভের থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার মতো অতীতের সবকিছু ভুলে গেছি। এখন আমি কীভাবে আগামী দিনে চলব, থাকব সেটা হচ্ছে বিষয়।
এ সময় তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আমার বাড়ি, ঘর নেই। এত বছর জেল খাটার পর আমার কিছুই নেই। আমি যে এখন আমি কারাগার থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়িতেও যাচ্ছি না। আমি আরেকজনের বাড়িতে গিয়ে উঠছি এখন। আমি এখন কি করে খাব? কোথায় যাব? কি করব? আমার এখন আর কিছু করার বয়স নেই। আমার ৭৪ বছর বয়স চলে।
তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার একটিই আবেদন, আমাকে যেন বাড়ি-ঘর ও একটি কর্মসংস্থান দিয়ে চলার মতো কিছু করে দেন। এটিই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন।
পরিবার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি জানি আমার একটি বোন ও ভাগিনা আছে। কিন্তু জেলে আসার পর আজ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়নি৷ দুই-একবার ফোনে কথা হয়েছে। কিন্তু তারা কখনো দেখা করতে আসেনি৷
কারাগার থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবেন জানতে চাইলে শাহজাহান বলেন, কারাগারে আমার সঙ্গে একজন আসামি ছিলেন। তিনি আমার সঙ্গে ভালো আচরণ করেছেন। আমিও তার সঙ্গে ভালো আচরণ করেছি৷ আমি তাকে বলেছি কোথায় যাবে? এখন তার সঙ্গেই যাচ্ছি৷
কারাগার থেকে বের হওয়ার পর নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিরাপত্তা কীসের? আমার হুকুমে তো কাউকে ফাঁসি দেওয়া হয়নি। রাষ্ট্রের হুকুমে তাদের ফাঁসি হয়েছে৷
২৬ জনকে ফাঁসির অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিটি ফাঁসিতে কোনো না কোনো আবেগ থাকে। কারণ মানুষ যত কিছুই করুক, যত অপরাধই করুক, মৃত্যুর মুখে পতিত যখন, তখন সবারই একটু না একটু মায়া লাগে। কিন্তু সেই মায়া আমি করলেও কোর্ট তাকে ক্ষমা করবে না, আইন ক্ষমা করবে না। আমি ফাঁসি না দিলে আরেকজন তাকে ফাঁসি দেবে। মায়া লাগলেও কাজটি আমাকে করতে হয়েছে।
এরাশাদ শিকদার, বাংলা ভাই, বঙ্গবন্ধুর খুনি ও যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এরশাদ শিকদাকে যখন আমি ফাঁসি দিলাম, তখন তিনি দাঁড়িয়ে একটি কথা বলেছিল- আমার জীবনে আমি কোনো অন্যায় করিনি, আমার জন্য দোয়া করবেন। আর বাংলা ভাই বলেছিলেন, মরার পর তার ছবি যেন না উঠানো হয়। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা কোনো কথা বলেনি। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ফাঁসির সময় চুপচাপ ছিলেন। মুনির ফাঁসির আগে সিগারেট চেয়েছিলেন।
‘জল্লাদ’ শাহজাহানের পুরো নাম শাহজাহান ভূঁইয়া। তিনি নরসিংদী জেলার পলাশ থানার ইছাখালী গ্রামের মৃত হাছেন আলীর ছেলে। ৭৩ বছর বয়সী শাহজাহান ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত ছিলেন। কারাগারে তার কয়েদি নম্বর ছিল ২৫৮৯/এ এবং মুক্তির আগ পর্যন্ত তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান জল্লাদ ছিলেন।
কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, শাহজাহান ১৯৯১ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রথম গ্রেপ্তার হয়ে মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে আসেন। দুটি মামলায় তার ৪২ বছরের সাজা হয়েছিল। পাশাপাশি সেসব মামলায় জরিমানা হয়েছিল পাঁচ হাজার করে ১০ হাজার টাকা।
কিন্তু কারাগারের মধ্যে ভালো কাজ এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করতে জল্লাদের দায়িত্ব পালনের জন্য তার সাজার মেয়াদ ১০ বছর মওকুফ (রেয়াত) করা হয়। পাশাপাশি শাহজাহানের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় আবেদনের প্রেক্ষিতে কারা কর্তৃপক্ষ তার জরিমানার ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করে দিয়েছে।
ফলে দীর্ঘ ৩১ বছর ছয় মাস দুই দিন কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি জীবন কাটানোর পর এখন তিনি মুক্ত।
শাহজাহানের দুই মামলার তথ্য:
স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল ১৮/১৯৯২, মানিকগঞ্জ ০৩(১২)৯১, ধারা- অস্ত্র আইন ১৯(এ)। এই মামলায় শাহজাহানের ১২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার সাজা হয়েছিল। জরিমানার অর্থ অনাদায়ে আরও ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ডের রায় হয়েছিল সেই মামলায়। যা কার্যকর শুরু হয় ১৯৯১ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে।
অপর মামলাটি হলো- দায়রা ৪০/৯২, মানিকগঞ্জ ২(১২)৯১, ধারা-৩৯৬দ:বি। এই মামলায় তার সশ্রম অর্থাৎ ৩০ বছরের সাজা হয়। পাশাপাশি পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ছয় মাস কারাদণ্ডের রায় হয়।
দুই মামলায় তার সাজা মওকুফ (রেয়াত) হয় ১০ বছর পাঁচ মাস ২৮ দিন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০২৩
এসসি/এসএএইচ