লালমনিরহাট: ছেলে জমি লিখে নিয়ে মা তছিরনকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর ওই মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জি আর সরওয়ার।
বুধবার (২৩ আগস্ট) বিকেলে আদিতমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোজাম্মেল হককে সঙ্গে নিয়ে তছিরনের কাছে যান ইউএনও।
এর আগে মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) ‘জমি লিখে নিয়ে মাকে বাড়ি ছাড়া করার অভিযোগ’ শিরোনামে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যা দেখে অসহায় বৃদ্ধার পাশে দাঁড়ান ইউএনও জি আর সারওয়ার।
বৃদ্ধা তছিরন বেওয়া (৭৫) আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের উত্তর গোবদা গ্রামের মৃত আনছার আলীর স্ত্রী। অভিযুক্ত আনোয়ার হোসেন (৫৫) তারই নাড়িছেঁড়া ধন একমাত্র ছেলে।
অভিযোগে জানা গেছে, জন্মের পর থেকেই বাবা-মাকে হারিয়ে অন্যের আশ্রয়ে বড় হন তছিরন। পরে উত্তর গোবদা গ্রামের আনছার আলীর সঙ্গে বিয়ে হয় তছিরনের। এক ছেলে এক মেয়ে রেখে দীর্ঘ ৫০ বছর আগে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে স্বামী আনছার আলী মারা যান।
অন্যের বাড়িতে ঝিঁয়ের কাজ করে মাত্র ছয় মাস বয়সী মেয়ে আনিছা ও তিন বছর বয়সী ছেলে আনোয়ার হোসেনকে বড় করেন। নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে ছেলে-মেয়েকে বড় করেছেন।
দীর্ঘদিন অন্যের জমিতে বসবাস করে ছেলে মেয়ের বিয়ের পর পৈত্রিক সূত্রে ৫৪ শতাংশ জমি পান তছিরন বেওয়া। ফলে সেই জমিতে শেষ বয়সে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় তার। সেই জমিই কাল হয়ে দাঁড়ায় বৃদ্ধার। বাড়ি করা ১১ শতাংশ জমি ছেলে আনোয়ার হোসেনকে এবং চাষাবাদের জমির ১৫ শতাংশ মেয়ে আনিছাকে দলিল করে দেন বৃদ্ধা। বাকি জমি থেকে আসা ফসল আর বয়স্ক ভাতার টাকায় চলত তার সংসার খরচ। ছেলে ও ছেলের বউ আম্বিয়ার (৪৮) আচরণে নিজে রান্না করে খেতেন বৃদ্ধা।
১০ মাস আগে ছেলে আনোয়ার হোসেন চাষাবাদের বাকি ২৮ শতাংশ জমি মায়ের কাছ থেকে দলিল করে নেন। এরপর মায়ের ওপর অত্যাচার বাড়িয়ে দেন। খোঁজ খবর নেওয়া বন্ধ করে দেন। উল্টো বিগত দিনে চিকিৎসা বাবদ মায়ের জন্য খরচ হওয়া ২০ হাজার টাকা দাবি করেন। দরিদ্র বৃদ্ধা তছিরন সেই টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় চার মাস আগে তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেন ছেলে আনোয়ার ও ছেলের বউ আম্বিয়া।
নিরুপায় হয়ে একমাত্র মেয়ে আনিছা বেগমের বাড়িতে যান বৃদ্ধা তছিরন। সেই থেকে মেয়ে জামাই তার দেখভাল করছেন। বৃদ্ধা মাকে স্থান দেওয়ায় বোনের ওপর ক্ষিপ্ত হন ভাই আনোয়ার ও তার স্ত্রী।
বিগত দিনের মত এ বছরও মায়ের কাছ থেকে পাওয়া ১৫ শতাংশ জমিতে আমন ধান রোপণ করেন আনিছা। গত শনিবার (১৯ আগস্ট) সেই জমিতে সার দিতে গেলে বাধা দেন আনোয়ার। দাবি করেন, মায়ের চিকিৎসা করাতে খরচ হওয়া সেই ২০ হাজার টাকা না দিলে জমিতে নামতে পারবে না। বৃদ্ধা তছিরন মেয়ের বাড়িতে থাকেন, তাই তার পাওনা টাকা মেয়ে আনিছাকেই পরিশোধ করতে হবে। অন্যথায় জমিতে নামতে পারবে না।
এদিকে চিকিৎসায় খরচ করা সেই ২০ হাজার টাকা ছাড়া বাড়ি ফিরলে বৃদ্ধা তছিরনকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছেন ছেলে আনোয়ার। এ ঘটনায় তছিরন বেওয়া ভরণপোষণ ও তার জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ছেলে, ছেলের বউ এবং দুই নাতির নামে গত রোববার (২০ আগস্ট) আদিতমারী থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
এমন একটি অভিযোগের ভিত্তিতে গত মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) বাংলানিউজে ‘জমি লিখে নিয়ে মাকে বাড়ি ছাড়া করার অভিযোগ’ শিরোনামে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। যা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্লাহর নজরে আসে। পরে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ওই বৃদ্ধার কাছে যান আদিতমারী ইউএনও জি আর সারওয়ার। বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলে মা-ছেলের মধ্যে সমঝোতা করে দেন তিনি।
ছেলের বউয়ের আচরণে বৃদ্ধা তছিরন বেওয়া ছেলের বাড়িতে পুনরায় ফিরতে রাজি না হলে মেয়ের বাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা করেন ইউএনও। মায়ের ভরণ পোষণের জন্য প্রতি মাসে নগদ টাকা ও ধান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন বৃদ্ধার ছেলে আনোয়ার হোসেন।
ইউএনও জি আর সারওয়ার বলেন, জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নির্দেশে বৃদ্ধা তছিরনের বাড়িতে গিয়ে তাদের মা-ছেলের বিরোধ মিটিয়েছি। বৃদ্ধার কথা মতো তাকে মেয়ের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করেছি। মায়ের ভরণপোষণের খরচ দেবেন ছেলে আনোয়ার।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০২৩
এসআই