গোপালগঞ্জ: গোপালগঞ্জের দত্তের মিষ্টি শুধু স্বাদেই সেরা নয়, মানেও অনন্য। এ দোকানের মিষ্টির স্বাদ নেননি, এমন মানুষ গোপালগঞ্জে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
আর তাদের ব্যবসার মূলমন্ত্র হলো নির্ভেজাল আর টাটকা মিষ্টি। এখানে কোনো বাসি মিষ্টি বিক্রি করা হয় না। তাই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভিন দেশেরও ছড়িয়ে পড়েছে দত্তের মিষ্টির সুনাম। বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এ মিষ্টি পাওয়া যায়।
গোপালগঞ্জ শহরের কোর্ট এলাকায় ছোট টিনের ঘর। ঘরের ভেতরে সামনের দিকে গ্লাস দিয়ে ঘেরা মিষ্টি রাখার জায়গা। দেখতে পরিপাটি না হলেও গুণ, মান আর স্বাদে ৮৫ বছর ধরে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে ‘দত্ত মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে গোপালগঞ্জ শহরের তৎকালীন মুনসেফ আদালত (বর্তমানে কোর্ট এলাকা) এলাকার আমগাছের নিচে ছোট একটা ঘরে দোকানটির যাত্রা। বসন্ত কুমার দত্ত তার ১৪ বছরের ছেলে সুধীর কুমার দত্তকে নিয়ে মিষ্টি তৈরি শুরু করেন। মিষ্টি বিক্রির টাকা দিয়ে চলত তার সংসার। বসন্ত দত্তের মৃত্যুর পর দোকানের হাল ধরেন সুধীর কুমার দত্ত। দিনে দিনে মানুষের মুখে মুখে দত্তের মিষ্টির নাম ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৯ সালে সুধীর দত্তের মৃত্যুর পর তার ছেলে সুরিত কুমার দত্ত ও সবুজ কুমার দত্ত দোকানটি পরিচালনা করছেন।
১৯৯৮ সালে দোকানটির স্থান পরিবর্তন হয়। বর্তমানে দোকানের পশ্চিম দিকে পৌরসভা, দক্ষিণে জেলা প্রশাসনের সুশাসন চত্বর, পূর্ব দিকে আইনজীবী সমিতির ভবন, উত্তর দিকে আদালত। এ এলাকাটি দত্ত মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের জন্য আরও বেশি পরিচিতি লাভ করেছে। অনেকের কাছে এটি ‘দত্তের মোড়’ হিসেবে পরিচিত।
দত্ত মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিকদের একজন সুধির কুমার দত্তের ছোট ছেলে সবুজ কুমার দত্ত বলেন, ঠাকুরদা শুরু করেছিলেন। এরপর বাবা। এখন আমরা দোকানটি পরিচালনা করছি। দত্তের মিষ্টির সুনাম একদিনে হয়নি। সেই সুনাম ধরে রাখাও সহজ ব্যাপার নয়। সুনাম ধরে রাখতে হলে মিষ্টির গুণগতমান ঠিক রাখতে হয়। দত্তের মিষ্টি তৈরিতে সব সময় টাটকা দুধ ব্যবহার করা হয়। মিষ্টিতে মিল্ক পাউডার, রং ও সুজি ব্যবহার করা হয় না। আমাদের তৈরি রসগোল্লা ও সন্দেশ তুলনামূলক কম মিষ্টি, তাই মানুষ বেশি পছন্দ করে।
গোপালগঞ্জে সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানসহ যে কোনো আয়োজনে দত্তের মিষ্টি থাকে উল্লেখ করে পবিত্র কুমার দত্ত বলেন, আমাদের মিষ্টি ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার অনেক দেশে যায়। ২০১৯ সালে মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার আমাদের দোকানে বসে মিষ্টি খেয়েছেন। সঙ্গে ৩০ কেজি মিষ্টিও কিনে নিয়ে যান। ২০২২ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির জন্য জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ২০ কেজি ছানার সন্দেশ পাঠানো হয়।
সবুজ কুমার দত্ত আরও বলেন, গোপালগঞ্জে যে কোনো সরকারি অনুষ্ঠানে দত্তের মিষ্টি থাকে। ভুটানের রাজাও আমাদের দোকানের মিষ্টির স্বাদ নিয়েছেন।
সুরিত কুমার দত্ত বলেন, আমরা বাগেরহাটের চিতলমারী ও গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থেকে খাঁটি গরুর দুধ সংগ্রহ করি মিষ্টি তৈরি করার জন্য। প্রতিদিনের দুধ দিয়ে প্রতিদিন মিষ্টি তৈরি করি। আমাদের দোকানে বসে মিষ্টি খাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিকেল থেকে ক্রেতারা দোকানে আসতে শুরু করেন গরম মিষ্টি কিনতে।
তিনি আরও বলেন, দত্ত মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে ১২ থেকে ১৫ জন শ্রমিক কাজ করেন। তাদের মধ্যে অনেকে ২০ থেকে ৩০ বছর ধরে কাজ করছেন।
এমন একজন শ্রমিক ফেরদাউস দাড়িয়া। তিনি বলেন, এখানে কাজের পরিবেশ ভালো। মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক বন্ধুসুলভ। তাই দীর্ঘদিন আনন্দের সঙ্গে এখানে কাজ করছি। মানুষ যখন দত্তের মিষ্টির সুনাম করে, ভালো বলে, তখন নিজের কাছেও ভালো লাগে।
গোপালগঞ্জের নবীনবাগ এলাকার গৃহবধূ মেহজাবীন বলেন, আমার সন্তানরা দত্তের রসগোল্লা খুব পছন্দ করে। দত্তের মিষ্টি ছাড়া অন্য কোনো দোকানের মিষ্টি ওরা খায় না। আসলে দত্তের মিষ্টি অন্যান্য দোকানের মিষ্টি থেকে আলাদা। পরিচ্ছন্ন পরিবেশে এখানে মিষ্টি তৈরি করা হয়। তাই এখানকার মিষ্টি বিখ্যাত। সুখ্যাতির কারণে আত্মীয় স্বজনদের জন্যও দত্তের মিষ্টি পাঠানো হয়।
গোপালগঞ্জ শহরের গাজী মাসুদুর রহমান বলেন, গোপালগঞ্জে দত্তের খাঁটি ছানার সন্দেশ আর রসগোল্লার স্বাদ গ্রহণ করেনি এমন মানুষ আসলে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখানে মানের ব্যাপারে কোনো আপস করা হয় না। আমাদের বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয় স্বজন এলে, তাদের জন্যও এ মিষ্টি কেনা হয়। এছাড়া পরিবারে মিষ্টি বলতে আমরা দত্তকে বুঝি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৩
এসআই/এসএম