ফেনী: এক সময় রাজত্ব ছিল আলোচিত-সমালোচিত প্রয়াত জয়নাল হাজারীর। এখন রাজত্ব নিজাম উদ্দিন হাজারীর।
দীর্ঘদিন এখানে সংসদ সদস্য ছিলেন জেলার আলোচিত ব্যক্তিত্ব জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন হাজারী। বেশ কয়েকবার এমপি হয়েছেন বিএনপির জয়নাল আবেদীন ভিপিও। আর বর্তমানে এমপির দায়িত্ব পালন করছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী। জয়নাল হাজারী এখন প্রয়াত। তবে এখনও ভোটের মাঠে তার প্রভাব শেষ হয়ে যায়নি। এমনটি দাবি তার সমর্থকদের।
সাধারণ ভোটাররা জানান, এ আসনে যিনি নির্বাচিত হন তিনি দলের প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছেন। প্রচলিত আছে, ফেনী শহর যার, জেলার রাজনৈতিক মাঠে শক্তি তার। আর এ শক্তির লড়াইয়ে বরাবরই আওয়ামী লীগ এগিয়ে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে চাঙ্গাভাব বিরাজ করছে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে। এ আসন থেকে এবারও তৃতীয় বারের মত দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী। দলীয় একাধিক সূত্রের দাবি আওয়ামী লীগে তার বিকল্প নেই বলেই আপাতত মনে করা হচ্ছে। তবে আরও বেশ কয়েকজনকে নিয়েও শুরু হয়েছে গুঞ্জন। এদের মধ্যে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি সাইফুদ্দিন নাছির, আওয়ামী লীগের কৃষি বিষয়ক উপকমিটির সহ-সম্পাদক অ্যাডভোকেট কাজী ওয়ালী উদ্দিন ফয়সালের নাম শোনা যাচ্ছে। এছাড়া প্রয়াত জয়নাল হাজারীর অনুসারী ফেনী জেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক এম শাখাওয়াত হোসেন ভূঞা এ আসন থেকে মনোনয়ন চাইবেন বলে তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন।
ফেনী সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শুসেন চন্দ্র শীলের মতে, শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তই আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্বাচনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। তবে সবকিছু বিশ্লেষণ করে নিজাম উদ্দিন হাজারীকেই মনোনয়ন দেবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। এখানে তার বিকল্প কেউ নেই। তিনি মনোনয়ন পেলে জনগণ ও দলীয় নেতাকর্মীরা সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে তার জন্য কাজ করবেন। এমনটি জানিয়েছেন ফেনী পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজীও।
এদিকে সাখাওয়াত হোসেন ভুঁইয়া বলেন, দলের কাছে আমি মনোনয়ন চাইব। দল মনোনয়ন দিলে অবশ্যই আমি বিজয়ী হব।
অপরদিকে টানা তিন মেয়াদ ক্ষমতার বাইরে থেকে হামলা-মামলায় জর্জরিত বিরোধী দল বিএনপি ও অন্য সব রাজনৈতিক দলে এখনও এ নির্বাচন ঘিরে তেমন কোনো আগ্রহ নেই। বিএনপিতে এ নির্বাচনকে ঘিরে এখনও বিরাজ করছে অস্থিরতা। তবে দলটির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ছড়া-ছড়ি দেখা যাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে থেমে নেই তৎপরতাও। জানা যায় দলীয় সরকারের প্রথা বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক দলটির প্রায় দুই ডজন মনোনয়ন প্রত্যাশী, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলনের পাশাপাশি দলের হাই কমান্ডের সু-নজরে আসার চেষ্টার করছেন।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দলগতভাবে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত হলে এ আসনটিতে বিএনপির মনোনয়ন পেতে পারেন দলের চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সাবেক তিনবারের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন (ভিপি)। দলটির বড় একটি অংশ এ নেতাকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান। এ দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে যাদের নাম বেশি শোনা যাচ্ছে তারা হলেন দলের কেন্দ্রীয় নেত্রী ও সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার রানু, সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত হাসান আহমেদ চৌধুরী, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শেখ ফরিদ বাহার, যুগ্ম আহ্বায়ক গাজী হাবীব উল্যাহ মানিক।
এদিকে জেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীদের একটি অংশ বলেন, ফেনী-১ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সভাপতি রফিকুল আলম মজনুও এ আসনটির মনোনয়ন চাইবেন। তাদের দাবি, ওই আসনে দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া অথবা তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে প্রার্থী করা হলে সেক্ষেত্রে এ আসনটির মনোনয়ন পেতে পারেন তিনি। তবে রাজনৈতিক মামলায় কারাগারে থাকায় এ ব্যাপারে তার কোনো মন্তব্য জানা যায়নি।
অপরদিকে এ আসন থেকে নির্বাচিত সাবেক তিনবারের সাংসদ ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবেদীন ভিপি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দেশে কোনো একতরফা নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হলে প্রতিবারের মতো এবারও তিনি প্রার্থী হবেন বলে জানান দলীয় নেতাকর্মীরা।
এ ব্যাপারে কথা হয় জেলা বিএনপি সদস্য সচিব আলাল উদ্দিন আলালের সঙ্গেও। তিনি জানান, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই এবারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। আর বিএনপি থেকে দলের হাইকমান্ড যাকেই ধানের শীষের মনোনয়ন দিবেন, তাকেই বিজয়ী করতে প্রস্তুত আছেন দলীয় নেতাকর্মীরা।
জেলার গুরুত্বপূর্ণ এ আসনটির পূর্বের নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করে জানা গেছে, গত নির্বাচনের শুরুতে নৌকা-ধানের শীষ হাড্ডাহাড্ডি দেখা দিলেও পরবর্তীতে ভোটের আগের রাতে সরকারি দল সব ব্যালট নিজেদের পক্ষে সীল মেরে বাক্সে রাখা হয়েছে এমন অভিযোগ এনে বর্জন করেছিলেন বিএনপি প্রার্থী জয়নাল আবেদীন (ভিপি)। ফলে অনেকটা প্রতিদ্বন্দ্বীহীন ওই নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ প্রার্থী। এর আগে ২০১৪ সালে বিএনপি জামায়াত জোট দলীয় সরকারে অধীনে নির্বাচনে না গিয়ে ভোট বর্জন করায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ওই একই প্রার্থী।
তার আগে টানা দুইবার এ আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বিএনপি-জামায়ত জোটের জয়নাল আবেদীন ভিপি। এরমধ্যে ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আ’লীগ প্রার্থী ইকবাল সোবহান চৌধুরী। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৮৬ হাজার ৭১৩ ভোট আর বিএনপি প্রার্থী পেয়েছিল ১ লাখ ২০ হাজার ২৯৭ ভোট।
তার আগে ২০০১ সালে অষ্টম সংসদ নির্বাচনে আ’লীগ প্রার্থী জয়নাল আবেদীন হাজারী নৌকা প্রতীক নিয়ে পেয়েছিলেন ৬৭ হাজার ২৫ ভোট। ওই নির্বাচেন বিএনপি জয়নাল আবেদীন ভিপি জামায়াতের সঙ্গে জোট করে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে পেয়েছিলেন ১ লাখ ১৫ হাজার ২৭৮ ভোট। যদিও ১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এককভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দিতা করে এ আসনটিতে পরাজিত হয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে আ’লীগ প্রার্থী জয়নাল আবেদীন হাজারী পেয়েছিলেন ৬৮ হাজার ৫৬৬ ভোট আর ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপি প্রার্থী ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী পেয়েছিলেন ৬২ হাজার ৬৪৭ ভোট।
এ কয়েকটি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ আসনটিতে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সব কয়টি নির্বাচনে আওয়ামীলীগ প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। পক্ষান্তরে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপির সাথে এককভাবে প্রতিদ্বন্দিতা করে মাত্র ৬ হাজার ভোটে জয় পেলেও ২০০১ ও ২০০৮ সালে জামায়াত সঙ্গে জোট করে প্রতিদ্বন্দিতা করায় প্রথমে প্রায় ৪৮ হাজার ও পরে ৩৪ হাজার ভোটে পরাজিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ।
ফেনী-২ আসনের সাধারণ ভোটারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এবারও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বয়কট করবে বিএনপি। সেক্ষেত্রে জয় নিশ্চিত আ’লীগের। আর বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো দাবির প্রেক্ষিতে নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ সরকারে অধীনে ভোট হলে গত দুইটি নির্বাচনের মতো ভোট মাঠে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না বর্তমান সরকারি দল। তবে, এক্ষেত্রে বিএনপি এককভাবে আ’লীগের সঙ্গে নির্বাচনী মাঠে নামলে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি।
আর বিএনপি জামায়াত জোটগতভাবে ভোট করলে নিশ্চিত পরাজয় বরণ করবে আওয়ামী লীগ। এর কারণ হিসেবে এ আসনটিতে আ’লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের মধ্যে সব কয়টিরই ভঙ্গুর অবস্থা ও বিএনপি জোটের প্রধান শরীক জামায়াতের শক্ত অবস্থানকে চিহ্নিত করেছেন তারা।
যদিও এবার জামায়াতের সঙ্গে আগের মতো সখ্যাতা দেখা যাচ্ছে না বিএনপির। আর এরই মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিশে সুরার সদস্য ও সাবেক জেলা আমির অধ্যাপক লিয়াকত আলী ভূঁইয়াকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে দলটি।
অপর দিকে ফেনীতে জাতীয় পার্টির তেমন কোনো অবস্থান না থাকলেও জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক জহির উদ্দিন মজুমদার (ভিপি জহির) এবং গত নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী খন্দকার নজরুল ইসলাম মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে। এছাড়া হাত পাখা প্রতীকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কাজী একরামুল হক ভুঁইয়া, এবি পাটির কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু ,কাস্তে প্রতীকে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির জসীম উদ্দীন, জাকের পার্টির নজরুল ইসলাম, খেলাফত মজলিসের মাওলানা জসিম উদ্দিনের নামও শোনা যাচ্ছে। নির্বাচনের অনেক দিন বাকি থাকলেও এসব রাজনৈতিক দলের প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকেরা ইতিমধ্যে তৎপরতা শুরু করে দিয়েছেন। বিশেষ করে সরকারি দল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন।
ভোটার- ফেনী-২ আসনের আওতাধীন ফেনী সদর উপজেলায় ১২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় মোট ভোটার ছিল ৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৬২ জন। হালনাগাদের পর ভোটার সংখ্যা বেড়েছে ৬২ হাজার ৬৫৩ জন। এ আসনে বর্তমান ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ১০ হাজার ৮১৫ জন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৩
এসএইচডি/এমএম/এফআর