রাজশাহী: পূর্ব দিগন্তে ভোরের আলো ফুটতেই প্রকৃতির মায়াবী মুখে স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে সূর্যের মিষ্টি কিরণ। ঝরা শিউলি, ছাতিম আর দূর্বাঘাসের ডগায় মুক্তোদানার মতো চকচক করছে রাতের নিহর।
আর শীতের এই পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে পদ্মাপাড়ের রুক্ষ শহর রাজশাহীতেও। প্রকৃতিতে যখন শীত কড়া নাড়ছে, ধুনকর পাড়ায় তখন শুরু হয়ে গেছে শীতের জোড় প্রস্তুতি। শীত মোকাবিলায় লেপ তোশকে পড়েছে সুঁই-সুতোর ফোড়। তাপমাত্রার পারদ যতই নিচে নামছে লেপ-তোশক বানানের ব্যস্ততা ততই বাড়ছে শহরের ধুনকর পাড়ায়।
বঙ্গাব্দ বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বর্তমানে কার্তিকের প্রথম সপ্তাহ চলছে। কার্তিক-অগ্রহায়ণ এ দুই মাস হেমন্তকাল। অন্য বছর হেমন্তের শেষ দিকে রাজশাহীতে শীতের আমেজ পাওয়া গেলেও ব্যতিক্রম ঘটেছে এবার। ‘আশ্বিন গা করে শিন শিন’ এই খনার বচন যেন বহু দিন পর প্রতিফলিত হতে দেখা যাচ্ছে হালের প্রকৃতিতে। আশ্বিনের শীতের আবেশ যেন পূর্ণতা পেতে চলেছে কার্তিকে। সন্ধ্যা হলে একটু মোটা কাপড় পরেই বের হতে হচ্ছে বাইরে। আর শেষ রাতে নকশিকাঁথা-কম্বল উঠছে শরীরে। বেলা গড়ালেই শরীরের ত্বকে মিলছে টানটান অনুভূতি। ভোরে ও সন্ধ্যায় সবুজ-শ্যামল গাছ-গাছালিতে পড়ছে স্বচ্ছ শিশিরের আস্তরণ। গ্রামীণ জনপদের পাশাপাশি শহুরে জীবনেও তাই এখন বিরাজ করছে শীতের স্নিগ্ধ আমেজ। বছরের টানা খরতাপের পর শীতোষ্ণ আবহাওয়া পুরোদমে উপভোগ করতে শুরু করেছেন- পদ্মাপাড়ের মানুষ। এজন্য বাসাবাড়িতেও চলছে শীতের আগাম প্রস্তুতি।
রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক লতিফা হেলেন জানান, গেল সপ্তাহ থেকে রাজশাহী অঞ্চলে দিনের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা থাকছে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরেই। আর দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা এসে দাঁড়িয়েছে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে। সাধারণত ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রা নেমে এলে শীত অনুভূত হয়।
তাই ঋতু পরিক্রমায় পুরোদমে শীত নামতে এখনও প্রায় এক মাস বাকি। কিন্তু রাজশাহীতে এখনই চলছে শীতের প্রস্তুতি। কারণ বরাবরই গরমের মৌসুমে গরম আর শীতের সময় শীত বেশি থাকে রাজশাহীতে। তাই পরিবারের জন্য ন্যাপথলিন দিয়ে বাক্সবন্দি করে রাখা লেপ-কাঁথা ও কম্বলসহ শীতবস্ত্র বের করছেন বাড়ির গৃহিণীরা। যেগুলো মেরামত করা দরকার সেগুলো মেরামত করে নিচ্ছেন। আর কিছু তৈরি করে নিচ্ছেন নতুন করেও।
বেশিরভাগ গৃহিণীরা বাড়ির লেপ-তোশক তৈরি ও পুরোনোগুলো মেরামতের জন্য এ সময়টাকে উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেন প্রতি বছর। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তাই মানুষের প্রয়োজন ও রুচি অনুযায়ী লেপ-তোশক তৈরি ও মেরামতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন রাজশাহীর ধুনকর পাড়ার কারিগররাও। এ সময়টা যে কেবল লেপ-তোশকই তৈরি করা হয় তা নয়। তৈরি করা হয় বালিশ, কোলবালিশ ও বিছানার জন্য জাজিমও। ধুনকরদের জন্য এটাই ভরা মৌসুম। এ সময়টা বিয়ের ভরা মৌসুম। এছাড়া নবজাতক জন্মের হারও বেশি। সেজন্য তুলা জাতীয় পণ্যের চাহিদাও দ্বিগুণ বেড়ে যায়। মহানগরীর বিভিন্ন এলাকার অলিগলি ঘুরে ঘুরেও তাই মৌসুমি ধুনকররা এখন লেপ-তোশক তৈরি করছেন।
কাক ডাকা ভোর থেকেই এখন বাড়ির আশপাশে এখন শোনা যাচ্ছে ধুনকরদের হাঁক-ডাক। সকাল হলেই তুলা, কাপড় ও ধুনার নিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন তারা। কেউ বাইসাইকেলে, কেউ বা ব্যাটারিচালিত রিকশাভ্যানে আবার কেউ পায়ে হেঁটে ঘুরছেন এপাড়ায়, ওপাড়ায়।
এছাড়া রাজশাহী শহরের তুলাপট্টি হিসেবে পরিচিত গণকপাড়া এলাকায় এখন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত লেপ, তোশক ও জাজিম তৈরির কাজ চলছে। ধুনারের টুং-টাং আওয়াজ আর বাতাসে উড়ে বেড়ানো শিমুল তুলার শুভ্রতা জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা।
রাজশাহীর এ তুলাপট্টি দোকানগুলোতে এখনই অতিরিক্ত কারিগর কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তাই পাড়া-মহল্লার মৌসুমি ধুনকরদের পাশাপাশি দোকানগুলোতেও শীতের অতিপ্রয়েজনীয় পণ্যগুলো তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে। তাই এই এলাকার কারিগরদের ব্যস্ততাও ক্রমশ বাড়ছে।
কেমন খরচ পড়ছে জানতে চাইলে তুলাপট্টির ব্যবসায়ী মহসীন আলী বাংলানিউজকে বলেন, বছর বছর তুলার দাম বাড়ছে। কাপড়, সুঁই-সুতোর দাম বাড়ছে। কারিগরের মজুরি বাড়ছে। কিন্তু সেইভাবে তারা পণ্যের দাম বাড়াতে পারছেন না। আগের মতো আর সেই রমরমা ব্যবসা নেই। শীত মৌসুমকে ঘিরে তাই কাজ বাড়লেও লাভ কম বলে দাবি করেন তিনি।
তিনি বলেন, বর্তমানে নতুন অর্ডারই বেশি। তবে প্রতিদিন কিছু মেরামতের কাজও আসছে। এখন গার্মেন্টসের তুলা দিয়ে একটা সিঙ্গেল লেপ তৈরি করতে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা, সেমি-ডাবল লেপ তৈরি করতে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা পড়ছে। আর ডাবল লেপ ২ হাজার ৫০০ টাকা। তবে কাপড় ও তুলার মান ভেদে ৩ হাজার টাকা থেকে শুরু করে এর ওপরেও রয়েছে।
এরমধ্যে সুতা, কাপড় ও কারিগরের খরচ রয়েছে। এছাড়া লেপ-তোশক তৈরি করতে তুলার মান ও পরিমাণ এবং বিছানার জন্য জাজিম তৈরি করতে নারিকেলের ছোবড়া ও কাপড়ের মানের ওপর নির্ভর করে তার দাম। যোগ করেন, ব্যবসায়ী মহসীন আলী।
এদিকে শিমুল তুলার দাম বেশি হওয়ায় এখন লেপ-তোশক তৈরিতে গার্মেন্টের ঝুট ও কার্পাস তুলাই বেশি ব্যবহার করা হয় বলে জাহিদ হোসেন নামের আরেক ব্যবসায়ী বাংলানিউজকে জানান, বর্তমানে মান ভেদে তিন ধরনের শিমুল তুলা বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে একটা প্রতি কেজি ৪০০ টাকা, একটা ৬০০ টাকা আর আরেকটা ৮০০ টাকা। এছাড়া বাজারে গার্মেন্ট তুলা প্রতি কেজি ৯০ থেকে ১০০ টাকা এবং কার্পাস তুলা ও শিশু তুলা ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে।
সাধারণত একটি ডাবল লেপ বানাতে ৩ থেকে ৫ কেজি পর্যন্ত তুলা লাগে। এগুলো তৈরির জন্য মজুরি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা এবং তোশক ও জাজিম তৈরি করতে ক্রেতাকে ৩০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত মজুরি দিতে হয় বলেও জানান জাহিদ হোসেন।
চলতি সপ্তাহ থেকে তাপমাত্রা কিছুটা কমছে। শেষ রাতে মিলছে শীতের আবেশ। তাই লেপ-তোশক তৈরির মৌসুম সদ্যই শুরু হয়েছে বলে উল্লেখ করে মহানগরীর গণকপাড়া এলাকার পুরোনো ধুনকর জাব্বার আলী বাংলানিউজকে বলেন, সারা বছর টুকটাক কাজ হয়। যা কাজ হয় তা দিয়ে কোনো রকম ডাল-ভাত খাওয়া যায়। তারা মূলত শীত মৌসুমের অপেক্ষায় থাকেন প্রতি বছরই। এ সময়টা লেপ-তোশক, জাজিম ও বিভিন্ন ধরনের বালিশ তৈরি ও মেরামতের ধুম পড়ে যায়। তাই এ সময়টা আয় রোজগারও অন্যান্য মাসের তুলনায় ভালো হয়।
বিশেষ করে বিয়ে বাড়ির অর্ডার পেলে লাভ বেশি হয়। শীত মৌসুমে বেশিরভাগ বিয়ের অনুষ্ঠান হওয়ায় ব্যস্ত সময় পার করেন তারা। নতুন বর-কনের জন্য লেপ-তোশক, জাজিম ও বালিশ ইত্যাদি তৈরিতে তারা বাড়তি উপার্জনের সুযোগ পান। এর সঙ্গে বাসাবাড়ি থেকেও লেপ-তোশকের অর্ডার আসতে থাকে। শীতে উচ্চবিত্তরা দামি কম্বল ব্যবহার করেন। তবে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা এখনও লেপ-তোশকের ওপরই নির্ভরশীল। তাই ব্যবসাটি টিকে আছে বলেও জানান ধুনকর জাব্বার।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০২৩
এসএস/আরআইএস