ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

আবারও রক্তাক্ত ২৮ অক্টোবর, পুরো ঘটনাপ্রবাহ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০২৩
আবারও রক্তাক্ত ২৮ অক্টোবর, পুরো ঘটনাপ্রবাহ

ঢাকা: উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার একটি দিন পার করলো গোটা দেশ। ২০০৬ সালের ভয়াল ২৮ অক্টোবরের পর চলতি বছরের এই দিনটিতেও রাজনৈতিক সংঘাতে রক্ত ঝরেছে।

নানা নাটকীয়তাসহ দিনের শুরুটা ভালো হলেও ত্রিমুখী সংঘর্ষে রক্ত ঝরলো শেষ পর্যন্ত। নিহত হয়েছেন এক যুবদল নেতা ও পুলিশ সদস্য। আহত হয়েছেন পুলিশ, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মীসহ অনেকে।

কয়েকদিনের রাজনৈতিক উত্তেজনার পর শুক্রবার নয়াপল্টনে বিএনপি ও বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে আওয়ামী লীগ সমাবেশ করার অনুমতি পায়। অনুমতি না পেয়েও শাপলা চত্বরেই সমাবেশ করার ঘোষণা দেয় জামায়াতও।

২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংঘাতে কর্মী হারানো জামায়াত ইসলামী অনুমতি ছাড়া সমাবেশ করার ঘোষণা দেওয়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে। আবারও রাজনৈতিক সংঘাতের শঙ্কায় চলতে থাকে নানা জল্পনা-কল্পনা।

একদিন আগের পরিস্থিতি
পূর্বঘোষিত মহাসমাবেশে যোগ দিতে গতকাল শুক্রবার বিকেল থেকে নয়াপল্টনে জড়ো হয় বিএনপি নেতাকর্মীরা। সারাদেশ থেকে ঢাকায় আসেন তারা।

অনুমতি না পাওয়া জামায়াত ইসলামী যেকোনো মূল্যে শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার ঘোষণা দেওয়া উৎকণ্ঠার পারদ উপরে উঠতে থাকে।

সকালে বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, বিকেলে রক্তক্ষয়ী সংঘাত
শনিবার (২৮ অক্টোবর) ভোর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে নয়াপল্টনে বিএনপি নেতাকর্মীদের ঢল নামে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী জড়ে হয়। দুপুরের আগ পর্যন্ত নয়াপল্টনে শান্তিপূর্ণভাবে বিএনপির সমাবেশ চলে।

এ সমাবেশের সীমা ছাড়িয়ে যায় ফকিরাপুল, বিজয়নগর ও কাকরাইল মোড় পর্যন্ত।

দুপুরে পর কাকরাইল মোড়ে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় বিএনপি নেতাকর্মীরা। কাকরাইল মোড় দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা যাওয়ার সময় বিএনপি কর্মীরা ধাওয়া দিলে সংঘর্ষ শুরু হয়।

এ সময় বিএনপি কর্মীরা প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা চালায়। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে অগ্নিসংযোগ করে।

এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ কর্মীরা কাকরাইল ছেড়ে গেলেও পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় বিএনপি নেতাকর্মীদের।

পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। গোটা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পরে বিজিবি মোতায়েন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে প্রশাসন।

পল্টনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া
কাকরাইল মোড়ের সংঘর্ষের উত্তাপ পৌঁছে যায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে। বিএনপি নেতাকর্মীরা নাইটিংগেল মোড় থেকে পুরানা পল্টন পার হয়ে জিরো পয়েন্টের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। অন্যদিকে বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেট থেকে পুরানা পল্টনে আসে আওয়ামী লীগ। এ সময় দফায় দফায় ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ পর্যায়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা পিছু হটে।

১ পুলিশ নিহত, আহত ৪১
বিএনপির সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় একজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। এছাড়া ৪১ জন পুলিশ সদস্য আহত হর বলে জানায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।

যুবদল নেতা নিহত
নয়াপল্টনে সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের গুলিতে শামীম মোল্লা নামে এক যুবদল নেতা নিহত হন। দুপুরে নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। নিহত শামীম মোল্লা মুগদা থানা যুবদলের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের এক নম্বর ইউনিটের সভাপতি। তার বাবার নাম ইউসুফ মোল্লা। সংঘর্ষে আহত হলে তাকে রাজারবাগ পুলিশ লাইন হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে সন্ধ্যার দিকে শামীম মোল্লা মারা যায় বলে নিশ্চিত করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব লিটন মাহমুদ।

পুলিশ হাসপাতাল-গাড়িতে আগুন
সংঘর্ষ চলাকালে বিএনপি ও জামায়াত কর্মীরা পুলিশ হাসপাতালে আগুন দেয় বলে দাবি করেন ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন।

পুলিশ হাসপাতালে অগ্নি সংযোগের ঘটনায় ৭টির মতো গাড়ি পুড়ে যায়। এছাড়াও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, বিআরটিসি ও বলাকা বাস এবং কয়েকটি মোটর সাইকেল পুড়িয়ে দেয় দুষ্কৃতিকারীরা।

আহত ৫ সাংবাদিক
পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় রাজধানীর কাকরাইলে হামলার শিকার হন বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত পাঁচ সাংবাদিক।

কাকরাইলে হামলায় আহত হন পলিটিক্যাল নিউজ বিডি অনলাইনের মাল্টিমিডিয়া জার্নালিস্ট মারুফ হাসান, বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট জাফর আহমেদ, দৈনিক কালবেলা পত্রিকার রাফসান জানি ও দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার এক সাংবাদিক। এছাড়াও রাজু আহমেদ নামে আরও এক সাংবাদিকের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

সকালে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, বিকেলে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ জামায়াতের
সকাল সাতটা নাগাদ নানা কৌশলে ফকিরাপুল-আরামবাগে জড়ো হতে থাকে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা।

এ সময় তারা শাপলা চত্বরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে বাধা দেয় পুলিশ। পরে জামায়াত কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশের সঙ্গে বাগ-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে। দুপুরের দিকে পুলিশি ব্যারিকেড ভেঙে আরামবাগের অবস্থান নেয় এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশ শেষ করে সবচেয়ে বেশি উত্তাপ ছড়ানো বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী।

বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে আওয়ামী লীগের সমাবেশ
বিএনপি-জামায়াতের ২৮ অক্টোবরের সমাবেশের পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ।

ফের তিন দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি
সমাবেশে পুলিশি বাধার অভিযোগ এনে বিএনপি রোববার সারাদেশে হরতালের ডাক দিয়েছে। পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে আওয়ামী লীগও সারাদেশে শান্তি সমাবেশের ডাক দেয়। হরতালের ঘোষণা দিয়েছে জামায়াতও

কারাগারে বিএনপি-জামায়াতের ৮৪১ নেতাকর্মী
বিএনপি-জামায়াতের মহাসমাবেশের দিনের আগের ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় তাদের ৮৪১ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

শনিবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালতে গ্রেপ্তার নেতাকর্মীদের হাজির করা হয়।
আদালত তাদের সবাইকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।

সিএমএম আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ঢাকা মহানগর এলাকার বিভিন্ন থানা থেকে মোট ৬৪৬ বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে এদিন আদালতে হাজির করা হয়। বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের অভিযোগ নেতাকর্মীর পক্ষে জামিন শুনানির সুযোগ পর্যায়ের দেওয়া হয়নি।

বাসে আগুন
রাজধানীর কাকরাইল মোড়ে ও মালিবাগ ফ্লাইওভারে বলাকা পরিবহনের বাসে এবং কমলাপুরে বিআরটিসি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। তবে কে বা কারা এ আগুন দিয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে র‌্যাব
র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, রাজধানীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমাবেশকে কেন্দ্র করে হামলার ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে কাজ করা হচ্ছে। শনিবার বিকেলে এ কথা জানান তিনি।

খন্দকার মঈন বলেন, ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমাবেশ কেন্দ্র করে কতিপয় দুষ্কৃতিকারী ও স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক রাজধানীর কাকরাইল, নয়াপল্টন, মতিঝিল ফকিরাপুলসহ বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষের ওপর সন্ত্রাসী হামলা ও আক্রমণ চালিয়েছে।

তিনি বলেন, সন্ত্রাসীরা গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। তারা প্রধান বিচারপতির বাড়িতেও হামলা চালায়। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা ও আক্রমণ চালায় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তাদের হামলায় আইনশৃঙ্খলার বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য হতাহত হন। সন্ত্রাসীরা রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে হামলা করে ও অ্যাম্বুলেন্সে অগ্নিসংযোগ করে। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বাড়িতেও হামলা করে।

বিভিন্ন সমাবেশে দায়িত্ব পালনরত গণমাধ্যম কর্মীদের ওপরও হামলা চালিয়েছে তারা। এছাড়াও, তারা বিভিন্ন সড়কে স্থাপিত সিসিটিভিও ভাঙচুর করা হয় বরে জানান খন্দকার মঈন।  

এই কর্মকর্তা বলেন, যে সব সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যমকর্মীসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী হামলা ও আক্রমণ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি করে জনজীবন বিপর্যস্ত করার চক্রান্তে লিপ্ত ছিল তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে কাজ করছে র‌্যাব।

র‌্যাবের গোয়েন্দারা গণমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত ফুটেজ, সিসিটিভি ফুটেজসহ সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে জড়িত দুষ্কৃতিকারী ও সন্ত্রাসীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ২১১৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০২৩
এমইউএম/ইইউডি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।