ঢাকা: একের পর এক মেগাপ্রকল্পের মাধ্যমে নতুন নতুন জেলা যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ের নেটওয়ার্কে। যোগাযোগের এই সহজ, আরামদায়ক ও সাশ্রয়ী নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হয়ে বর্তমানে ৪৮ জেলায় পৌঁছে গেছে।
কিন্তু কম জনবলের কারণে বিস্তৃত নেটওয়ার্কে প্রান্তিক পর্যায়ে অপারেশন কার্যক্রম যথাযথভাবে চালানো যাচ্ছিল না। অবশেষে পরিকল্পনা নেওয়ার দীর্ঘ এক দশক পরে বাংলাদেশ রেলওয়েকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে নেওয়া পদক্ষেপ গতি পাচ্ছে।
পরিকল্পনার আওতায়, বাংলাদেশ রেলওয়ের বিদ্যমান দুইটি অঞ্চলকে বিকেন্দ্রীকরণ করে চারটি অঞ্চল করা হবে। আর বিদ্যমান চারটি বিভাগকে বিস্তৃত করা হবে আট বিভাগে।
বর্তমানে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে গঠিত রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা নিয়ে। পশ্চিমাঞ্চলকে ভেঙে খুলনা ও বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা নিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের নতুন অঞ্চল ‘দক্ষিণাঞ্চল’র প্রস্তাব করা হয়েছে।
দক্ষিণাঞ্চলের অধীনে পরিচালন বিভাগ হিসেবে যথাক্রমে যশোর ও ফরিদপুর করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে বর্তমানে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে গঠিত চট্টগ্রাম, সিলেট, ঢাকা ও ময়মনসিংহ এলাকা নিয়ে। এর মধ্যে ঢাকা ও ময়মনসিংহ এলাকা নিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের নতুন অঞ্চল ‘মধ্যাঞ্চল’র প্রস্তাব করা হয়েছে। ‘মধ্যাঞ্চল’র সদর দপ্তর হচ্ছে ময়মনসিংহ।
‘মধ্যাঞ্চল’র অধীনে পরিচালন বিভাগ হিসেবে ময়মনসিংহ ও ঢাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে থেকে ঢাকা বিভাগ বাদ পড়লে নতুন পরিচালন বিভাগ হিসেবে সিলেটকে প্রস্তাব করা হয়েছে।
আর রাজশাহী ও রংপুর নিয়ে গঠিত রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের পরিচালন পরিধির এলাকা কমলেও বিদ্যমান পরিচালন বিভাগ- পাকশী (পাবনা) ও লালমনিরহাট অপরিবর্তিত থাকছে।
এ নিয়ে গত মঙ্গলবার (৫ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি সভা হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান। সভার কার্যবিবরণীর একটি কপি বাংলানিউজের কাছে রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, তাদের চার অঞ্চল নিয়ে প্রস্তাবনা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সেই অনুযায়ী তারা কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছেন। এখানে এখনো অনেক বিষয় আছে। এটি নিয়ে আরও অনেক সভা হবে।
রেলের মহাব্যবস্থাপক (পশ্চিম) ও প্রস্তাবনা কমিটির সদস্য অসীম কুমার তালুকদার বলেন, তারা একটা প্রস্তাবনা পাঠিয়েছেন ঢাকায়। এখন রেলওয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।
এদিকে সভায় দ্রুততার সঙ্গে নতুনভাবে প্রস্তাবিত বিভাগসমূহের অধিক্ষেত্র, জনবলসহ পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পার্সোনেল শাখার মাধ্যমে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন রেলওয়ের মহাপরিচালক।
এই বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, এসব পরিকল্পনা অনেক আগেই নেওয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। যেহেতু রেল বর্ধিত হচ্ছে তাই অঞ্চল ভাগ করার চিন্তাভাবনাও রয়েছে। আস্তে আস্তে সেটি করা হবে।
এক দশক পরে বাস্তবায়নের পথে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন
এক দশক আগে ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলপথ মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে সুষ্ঠুভাবে ট্রেন পরিচালনার লক্ষ্যে এই অনুশাসন প্রদান করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে দুটি কমিটি গঠন করেছিল রেলপথ মন্ত্রণালয়। ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর তৎকালীন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক এ সংক্রান্ত সুপারিশ রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সভায় উত্থাপন করেন। এতে একটি কমিটি চারটি অঞ্চল ও পাঁচটি নতুন পরিচালন বিভাগ এবং আরেকটি কমিটি চারটি অঞ্চল ও আটটি পরিচালনা বিভাগে বিভক্তির প্রস্তাবনা দিয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত ২০১৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অঞ্চল ও বিভাগ বিভক্তির চূড়ান্ত প্রস্তাবনা দেয় গঠিত কমিটি। একইসঙ্গে জনবল কাঠামোতেও পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত হয়। বর্তমানে রেলওয়েতে দুটি অঞ্চল ও চারটি বিভাগে ৪৭ হাজার ৬৩৭ অনুমোদিত জনবল আছে।
অঞ্চল ও বিভাগ বাড়ানোর সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট বাংলাদেশ রেলওয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক ৭ হাজার ৩০৯ জনবল বাড়িয়ে ৫৪ হাজার ৩৪৬ করার প্রস্তাব করেন।
ডিও লেটারের বদৌলতে ফরিদপুরের বদলে আঞ্চলিক সদর দপ্তর খুলনা
রেলওয়ে সূত্র জানায়, এক প্রস্তাবনায় চট্টগ্রাম ও সিলেটকে পরিচালনা বিভাগ রেখে চট্টগ্রামের সিআরবি পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তর, পাকশী ও লালমনিরহাটকে পরিচালনা বিভাগ রেখে রাজশাহীকে পশ্চিমাঞ্চলের সদর দপ্তর, ময়মনসিংহ ও ঢাকাকে পরিচালনা বিভাগ রেখে ময়মনসিংহকে উত্তরাঞ্চলের সদর দপ্তর, রাজবাড়ী ও খুলনাকে পরিচালনা বিভাগ রেখে ফরিদপুরকে দক্ষিণাঞ্চলের সদর দপ্তর করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়।
এ প্রস্তাবনার আলোকেই অঞ্চল ও বিভাগের বিভক্তি চলতি সরকারের মেয়াদেই চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত দক্ষিণাঞ্চলের সদর দপ্তর খুলনা নাকি ফরিদপুর হবে তা নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হলে তা থমকে যায়। ২০২৩ সালের মার্চে খুলনা অঞ্চলের সংসদ সদস্য শেখ সালাউদ্দিন জুয়েল ও শেখ হেলালউদ্দিন খুলনায় দক্ষিণাঞ্চলের সদর দপ্তর করতে মন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ৪ জুন রেলওয়ে মহাপরিচালককে প্রতিবেদন দিতে বললে সেপ্টেম্বর মাসে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এতে খুলনাকেই দক্ষিণাঞ্চলের সদর দপ্তর করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ে এখন ফরিদপুরের বদলে খুলনাকে দক্ষিণাঞ্চলের সদর দপ্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এদিকে মঙ্গলবারের সভায় অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার শাহাদাত জানান, খুলনা শহরে বাংলাদেশ রেলওয়ের অনেক অব্যবহৃত ভূ-সম্পত্তি এবং স্থাপনা রয়েছে। মোংলা বন্দর খুলনার সন্নিকটে। এছাড়া খুলনা একটি প্রশাসনিক বিভাগীয় শহর। বর্ণিত বিষয়সমূহ উল্লেখপূর্বক তিনি খুলনা শহরে ‘দক্ষিণাঞ্চল’র সদর দপ্তর স্থাপনের পক্ষে মত প্রকাশ করেন।
এসময় মহাপরিচালক কামরুল আহসান বলেন, রাজবাড়ীতে একটি ক্যারেজ ওয়ার্কশপ নির্মাণের কাজ প্রক্রিয়াধীন। ক্যারেজ ওয়ার্কশপ রাজবাড়ীতে স্থাপিত হওয়ার পর এ জেলার অন্তর্গত রেলওয়ের ভূ সম্পত্তি ও স্থাপনা সমূহের সদ্ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, নতুন দুটি অঞ্চলের জন্য অতিরিক্ত আরও ১০ থেকে ১৫ হাজার জনবল নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। নতুনভাবে দুটি সদর দপ্তর ও চারটি বিভাগীয় কার্যালয়ে এসব জনবল নিয়োগ করতে হবে। তবে বর্তমানে রেলের বিদ্যমান অবকাঠামোতেই কার্যালয় করা সম্ভব হবে। কেবল কিছু অতিরিক্ত স্থাপনা প্রয়োজন হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০২৩
এনবি/এইচএ/