ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

রিকশাচিত্র: সমাজের চলমানতার প্রতিচ্ছবি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০২৩
রিকশাচিত্র: সমাজের চলমানতার প্রতিচ্ছবি অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ঢাকার রিকশাচিত্র | ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করলেই যে বাহনটি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়বে, সেটা হলো তিন চাকার বাহন রিকশা। বাংলাদেশের বাইরে আর কোনো দেশেই এত রিকশা নেই।

এজন্যই হয়তো ঢাকাকে রিকশার নগরী বলেন অনেকে। রিকশার গায়ের উজ্জ্বল রঙে আঁকা চিত্রগুলোকে গণমানুষের চিত্র বলেও উল্লেখ করা হয়। আর রিকশাচিত্রের শিল্পগুণ তো রয়েছেই।

সম্প্রতি (৬ ডিসেম্বর) ঢাকার রিকশা ও রিকশাচিত্র ইউনেসকোর ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি বা অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আর তারপর থেকেই রিকশাচিত্র নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। কথা হচ্ছে রিকশার ঐতিহ্য ও রিকশাচিত্রে কাজ করা উদ্যোক্তাদের নিয়ে।

পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় রিকশা পেইন্টিংয়ের প্রচলন শুরু হয়। সে সময় রিকশা সাজানোর পাশাপাশি এতে ফুটিয়ে তোলা হতো দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থাও। ছিল আলাদা সমাদরও। কিন্তু অসংখ্য বিবর্তনের মাঝেও রিকশাচিত্রের প্রাণভোমরা হচ্ছেন শত বাধা–বিপত্তি আর অভাব–অনটন পার করে এ শিল্পকে যারা যুগ যুগ ধারণ করে আছেন, সেই সব রিকশা চিত্রশিল্পীরা। তাদেরই একজন সৈয়দ আহমেদ হোসেন। প্রায় ৫৫ বছর ধরে তিনি এই রিকশাচিত্রের কাজ করছেন তিনি।

চারদিকে যখন রিকশাচিত্র নিয়ে এত শোরগোল, এই স্বীকৃতি পাওয়ার অনুভূতি তার কাছে কেমন জানতে চাইলে সৈয়দ আহমেদ হোসেন বলেন, ‘অনেক দিনের পরিশ্রমের পর আমরা এই স্বীকৃতি পেয়েছি। এটা অবশ্যই আনন্দের। যে সময় যে ঘটনা ঘটে, সেটা আমরা তুলে ধরে আর্ট করেছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা মুক্তিযুদ্ধের আর্ট করলাম। কীভাবে পাকিস্তানি আর্মিরা অত্যাচার করল এসব। ’


রিকশাচিত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে কাজ করে গেছেন সৈয়দ আহমেদ হোসেনের মতো গুণী শিল্পীরা | ছবি: সংগৃহীত

রিকশাচিত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে, রিকশা চিত্রশিল্পীরাও যে শিল্পী, এই স্বীকৃতি বিশেষ প্রয়োজন ছিল। দেশ-বিদেশের এমন জনপ্রিয়তা পাওয়ার আগে আধুনিকতার ছোঁয়ায় রিকশাচিত্র এক সময় প্রায় হারাতেই বসেছিল। ব্যাপারটা যে শুধু এখনই এমন, তা নয়। এর আগে ১৯৭০ সালের দিকে রিকশায় নায়ক-নায়িকা বা মানুষের ছবি আঁকার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। তখন আর্টের ধরন পাল্টে ফেলেন শিল্পীরা। তবে থেমে থাকেনি এই শিল্প।

এ বিষয়ে কথা হলে রাজধানীর রিকশা পেইন্টার সৈয়দ আহমেদ হোসেন বলেন, ‘আমরা চিন্তাভাবনা করলাম, আমরা নতুন কিছু করি। তখন আঁকলাম জীবজন্তু মানুষের মতো কাজ করছে। আশির দশকে রিকশা আর্টে আবারও সিনেমার পোস্টার আঁকা শুরু হয়। যারা সিনেমার ব্যানার আর্ট করতো, তাদের কাজ নেই তখন। মেশিন এসে পড়েছে অনেক, বড় বড় পোস্টার করে ওগুলো টাঙিয়ে দিতো। তখন ওরা পোস্টার ছেড়ে রিকশা আর্টে চলে আসে। যে সিনেমা একটু জনপ্রিয় হলো, যেমন নিশান, বেদের মেয়ে জ্যোসনা—এরকম আরও অনেক সিনেমা দৃশ্য রিকশায় অনেক চলতো। ’

তার কথায়, ‘নব্বইয়ের দশকে কে কত সুন্দর রিকশা বানালো, এই নিয়ে প্রতিযোগিতা চলতো মহাজনদের মাঝে। ওই সময় মানুষের মাঝে রিকশার প্রতি একটা আলাদা আগ্রহ ছিল। রিকশায় আয়ও ছিল ভালো। রিকশা তুলে দেওয়া হবে, এমন একটা চাপ আসছিল। এরপর থেকে যে যেভাবে পারে, কোনো মতে রাস্তায় রিকশা নামিয়ে দিয়ে টাকা পেলেই হয়েছে। কারণ সাজিয়ে ছাড়লে রিকশা থেকে যে টাকা আয় হবে, না সাজালেও আয় সেই টাকাই। তাই এখন আর রিকশা পেইন্ট করে চলা সম্ভব না। বংশ পরম্পরায় কেউ কেউ এটার সঙ্গে থাকলেও নতুনদের আগ্রহ বেশ কম। ’

কথা হচ্ছে রিকশার ঐতিহ্য ও রিকশাচিত্রে কাজ করা উদ্যোক্তাদের নিয়ে। তাদেরই আরেকজন মোহাম্মদ হানিফ পাপ্পু। ঢাকার এই শিল্পীও গত প্রায় ৫৫ বছর ধরে রিকশাচিত্রের কাজ করছেন।


রিকশাচিত্রের অন্যতম প্রাণভোমরা হানিফ পাপ্পু | ছবি: সংগৃহীত

তিনি জানান, স্বাধীনতার পর থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এঁকেছেন সিনেমার ব্যানার ও পোস্টার। সিনেমা হিট হলে হানিফ পাপ্পুর কাছে রিকশা গ্যারেজের লোকেরা ধরনা দিতেন। চাহিদা ছিল, রিকশার পেছনের প্লেটে সেই সিনেমার ব্যানার এঁকে দিতে হবে। ‘নিশান’, ‘অবুঝ মন’, ‘দুই রাজকুমার’, ‘দোস্ত দুশমন’, ‘সত্যের মৃত্যু নেই’, ‘বেদের মেয়ের জ্যোসনা’—বিরামহীনভাবে সব হিট মুভির ছবি এঁকেছেন পাপ্পু তখন রিকশার জন্য। এরপর যখন রিকশায় ডিজিটাল আর্ট বসানো চালু হয়, তখন অনেক রিকশাচিত্রশিল্পী পেশা বদল করেন।

হানিফ পাপ্পু পণ করলেন, ‘ভাতে মরলেও এই কাজ আমি ছাড়ব না’। তার মাথায় নতুন বুদ্ধি এলো, বিয়ের ব্যানার বানানো। নতুন উদ্যমে শুরু করেন সেই কাজ। হলুদ কিংবা বিয়ের অনুষ্ঠানে বর-কনেকে নায়ক-নায়িকা আর শ্বশুর-শাশুড়িকে ভিলেন করে কিছু ব্যানার আঁকেন। সেটিও জনপ্রিয়তা পায়। তবে কিছুদিন যেতে না যেতে বিয়ের ব্যানারও ডিজিটাল হয়ে যায়।

পেট চালানোর তাগিদেই ছোট জিনিসপত্রে আঁকা শুরু করেন হানিফ পাপ্পু। হারিকেন, চায়ের কাপ, কেটলি, চশমা ইত্যাদিকে রিকশাচিত্রের মতোই রাঙাতে থাকেন। ক্রমেই এই রঙিন হারিকেন, মগ, কেটলি, চায়ের কাপ লোকজনের প্রশংসা কুড়াতে থাকে। উদ্যোক্তারা খুঁজে বের করতে থাকেন রাজধানীর রিকশাচিত্রশিল্পীদের। যাদের হাতের ছোঁয়ায় সবকিছুই বর্ণিল হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশ রিকশা আর্ট সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, রিকশা ও রিকশাচিত্রের ইউনেসকো স্বীকৃতি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। এতে যারা সহযোগিতা করেছেন, আমরা তাদের কাছে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। আর রিকশাচিত্র নিয়ে নতুন যেসব উদ্যোক্তা কাজ করছেন, তাদের কাছে অনুরোধ- রিকশাচিত্রের মোটিফটা যেন নষ্ট না হয়। রিকশাচিত্রের ঐতিহ্য ও ইতিহাস যেন টিকে থাকে অমলিন হয়ে। তবেই শিক্ষিত শিল্পীদের হাতে বেঁচে থাকবে এই শিল্প, যোগ হবে নতুন সব মাত্রা।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০২৩
এইচএমএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।