ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

দুই বছর পর জানা গেল ‘নিখোঁজ’ শ্রমিকের মৃত্যুর রহস্য

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০২৪
দুই বছর পর জানা গেল ‘নিখোঁজ’ শ্রমিকের মৃত্যুর রহস্য নিহত মফিজুলের স্বজনরা ইনসেটে মফিজুল।

নাটোর: প্রায় দুই বছর ধরে বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ ছিলেন নাটোরের গুরুদাসপুর পৌরসভার খলিফাপাড়া এলাকার মাফিজুল ইসলাম (২৫) নামে এক যুবক।  

এতদিন স্বজনরাসহ আশপাশের মানুষ জানতেন মাফিজুল ইসলাম নিখোঁজ রয়েছেন।

কিন্তু হঠাৎ জানা গেল তিনি নিখোঁজ ছিলেন না, তাকে হাত-পা বেঁধে মুখে স্কচটেপ দিয়ে শ্বাসরোধ করে এবং বুকে ধারালো শাবলের আঘাতে হত্যা করা হয়েছে। শুধু তাই নয় ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে তার মরদেহ স্থানীয় একটি মাদরাসার সেপটিক ট্যাংকের পাশে মাটিতে পুঁতে রাখে হত্যাকারীরা।

এ ঘটনার দুই বছর পর অবশেষে সেই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন হলো নাটকীয় কায়দায়। যা ছিল অনেকটাই সিনেমার গল্পের মত। একটি পরকীয়া ঘটনার অবসান ঘটাতে মফিজুলকে এক নারীর স্বামী, বাবা ও অপর পরকীয়া প্রেমিক মিলে নির্মমভাবে হত্যার পর মরদেহ গুম করে, যা এতোদিন কেউ জানতেন না।

ঘটনাক্রমে স্ত্রীর সঙ্গে দাম্পত্য দ্বন্দ্বের মামলায় জেলে যাওয়া ওই নারীর স্বামী মো. আল হাবিব সরকার (২৫) অনেক দুঃখে সম্প্রতি তার সঙ্গে বন্দি থাকা জাকির মুন্সি (৪০) নামে এক আসামিকে (একই এলাকার)   দুই বছর আগে শ্বশুরদের সঙ্গে মিলে স্ত্রীর পরকীয়া প্রেমিককে হত্যার পরে মরদেহ গুমের গল্প শোনান। আর ওই গল্প শোনানোর পরই বেরিয়ে আসে গুরুদাসপুরের চাঁচকৈড় খলিফাপাড়া গ্রামের “মাফি বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ফ্যাক্টরির নিখোঁজ শ্রমিক মাফিজুল ইসলাম হত্যার চাঞ্চল্যকর আসল তথ্য।

সম্প্রতি মো. জাকির মুন্সি আদালত থেকে জামিন পেলে জেলহাজত থেকে বের হয়ে বিষয়টি নিহত মাফিজুল ইসলামের মাসহ অন্যান্য লোকজনের কাছে প্রকাশ করেন। পরে এ হত্যার ঘটনায় বাদী হয়ে মাফিজুলের মা মাইনুর বেগম গুরুদাসপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলা দায়েরের পর থেকেই আশরাফুল ইসলামসহ ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্য আসামিরা আত্মগোপনে চলে যান।

আর চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলা দায়েরের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আসামি আশরাফুল ইসলামকে (৪২) (ওই নারীর অপর পরকীয়া প্রেমিক) শনিবার (০২ মার্চ) সকাল পৌনে ৯টার দিকে সিরাজগঞ্জ জেলার বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানাধীন গোলচত্বর থেকে আটক করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৫)। আশরাফুল ইসলামও জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাবকে এ হত্যাকাণ্ডের একই তথ্য দিয়েছেন।  

অন্যদিকে এ ঘটনায় মাদরাসার নৈশপ্রহরী আবু তাহের খলিফা (৫৫) এবং তাঁর মেয়েকেও (২৮) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে তাদের আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।

অন্যদিকে জেলহাজতে থাকা আল হাবিব সরকারকেও (৩৫) এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ।

এদিকে তাদের দেওয়া তথ্যমতে পুঁতে রাখা মরদেহ উত্তোলনের জন্য শনিবার (০২ মার্চ) সন্ধ্যা পর্যন্ত আদালতের অনুমতির অপেক্ষায় ছিল পুলিশ। বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হলে ঘটনাস্থলে ভিড় জমায় উৎসুক জনতা। পরে উৎসুক জনতার ভিড় আর আদালতের অনুমতির অপেক্ষায় ঘটনাস্থল চাঁচকৈড় পুরানপাড়ার বালিকা মাদরাসার সেপটিক ট্যাংকের আশপাশের এলাকা ঘিরে রেখেছে পুলিশ।  

আজ রোববার (০৩ মার্চ) আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে নিহতের মরদেহ উত্তোলন করা হবে।  

গুরুদাসপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. উজ্জ্বল হোসেন বাংলানিউজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এর আগে শুক্রবার (০১ মার্চ) দিনগত রাতে নিহত মাফিজুলের মা মাইনুর বেগম বাদী হয়ে গুরুদাসপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় গ্রেপ্তার চারজনসহ আরও তিন থেকে চারজনকে সন্দেহভাজন আসামি করা হয়েছে। র‌্যাব-৫ নাটোর ক্যাম্পের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

নিহত মো. মফিজুল ইসলাম গুরুদাসপুরের চাঁচকৈড় খলিফাপাড়া এলাকার মো. আজাত মোল্লা ও মোছা. মাইনুর বেগম দম্পতির ছেলে। গ্রেপ্তার মো. আল হাবিব সরকার সিরাজগঞ্জের তাড়াশের তালোম কাচারিপাড়া এলাকার মো. ওজারত আলীর ছেলে এবং মো. আশরাফুল ইসলাম গুরুদুসপুরের খামাড়নাচকৈড় এলাকার মো. আব্দুস সামাদের ছেলে।

এদিকে র‌্যাবের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, নিহত মাফিজুল ইসলামের সঙ্গে বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে চাকরির সময় নৈশপ্রহরী আবু তাহের খলিফার মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ নিয়ে মেয়েটির সংসারে কলহ দেখা দেয়। বিষয়টি নিয়ে তার বাবার কাছে জামাতা হাবিব অভিযোগ করেন এবং মাফিজুল ইসলামকে মোবাইল ফোনে হত্যার হুমকিও দেন।  

এদিকে ক্ষিপ্ত হয়ে ২০২২ সালের ১৭ এপ্রিল কৌশলে মাফিজুলকে তার বাসায় ডেকে নেন মেয়ের বাবা আবু তাহের। একই সঙ্গে রাতে তাকে নিজের কর্মস্থল চাঁচকৈড় বালিকা দাখিল মাদরাসায় নিয়ে যান। সেখানে মাফিজুলকে হাত-পা বেঁধে, মুখে স্কচটেপ দিয়ে শ্বাসরোধ করে এবং ধারালো শাবল দিয়ে বুকে সজরে আঘাত করলে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়।

পরে ঘটনা ধামাচাপা দিতে আশরাফুল ইসলাম অন্যান্য আসামিসহ মাফিজুল ইসলামের মরদেহ একটি প্লাস্টিকের রাস্তায় ভরে বাড়ির কাছে মাদরাসার সেপটিক ট্যাংকের পাশে পুঁতে রাখে। বিষয়টি গত দুই বছর ধরে ধামাচাপা ছিল। অন্যদিকে ছেলে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় মাফিজুলের মা মাইনুর বেগম গুরুদাসপুর থানায় একই বছরের ৭ মে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন।

আর এতদিনে ছেলে হারানোর শোক কাটিয়ে উঠেছিলেন বাবা-মা। প্রায় দুই বছর পর পরিবারটি জানতে পারে, তাকে খুন করা হয়েছে। এখন আবার নেমে আসে শোকের ছায়া। ছেলের মৃত্যুর খবরে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন বাবা আজাত মোল্লা ও মা মাইনুর বেগম। তাদের কান্নায় আশপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। এলাকার মানুষ ও স্বজনরা বাড়িতে ভিড় করতে থাকেন। আর ছেলের মরদেহ দেখতে অধীর আগ্রহে আছেন বাবা-মাসহ স্বজনরা।

অপরদিকে এ হত্যাকাণ্ডের পর আল হাবিব ও তার স্ত্রীর সঙ্গে পারিবারিক কলহ বেড়ে যায়। একপর্যায়ে স্বামীর বিরুদ্ধে যৌতুক ও নারী নির্যাতনের মামলা দায়ের করেন স্ত্রী। সেই মামলায় জেলা কারাগারে আছেন আল হাবিব।

কারাগারে থাকা অবস্থায় গুরুদাসপুরের খলিফাপাড়ার জাকির মুন্সির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে হাবিবের। একপর্যায়ে দুঃখ-কষ্ট নিয়ে অকপটে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি তাকে খুলে বলেন। এর কিছুদিন পরে জাকির মুন্সী আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে মাফিজুলের পরিবারকে ঘটনাটি খুলে বলেন। পরে পুলিশকে জানান পরিবারের সদস্যরা। পুলিশ বিষয়টি আমলে নিয়ে অভিযুক্ত মেয়ে ও তার বাবা আবু তাহের আটক করেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পুলিশের কাছে স্বীকার করেন তারা। আর এ ঘটনায় র‌্যাবও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি ও ছায়াতদন্ত শুরু করে। র‌্যাব-৫ নাটোর ক্যাম্পের সদস্যরা এ মামলার আসামি আশরাফুল ইসলামকে শনিবার (০২ মার্চ) সিরাগঞ্জের গোলচত্বর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে।

এদিকে ছেলে মাফিজুল হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শাস্তি দাবি করেছেন নিহত মাফিজুলের মা মাইনুর বেগমসহ স্বজনরা। আর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. মাজাহারুল ইসলাম জানিয়েছেন, আজ রোববার আদালতের নির্দেশ মোতাবেক একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট্রের উপস্থিতিতে নিহতের মরদেহ উত্তোলন করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩২ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০২৪
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।