ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘শেখ মুজিবকে বলেছিলাম আমি কিছু চাই না, আমার কিছু লাগবে না’

হারুন-অর-রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০২৪
‘শেখ মুজিবকে বলেছিলাম আমি কিছু চাই না, আমার কিছু লাগবে না’

ফরিদপুর: নূর মোহাম্মদ। যিনি ‘ক্যাপ্টেন বাবুল’ নামেই বৃহত্তর ফরিদপুর তথা বাংলাদেশের মানুষের কাছে অধিক পরিচিত।

‘স্টেট ভার্সেস শেখ মুজিব অ্যান্ড আদারস’ অর্থাৎ ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব এবং অন্যান্য’ মামলার ৫ নম্বর আসামি ছিলেন ক্যাপ্টেন বাবুল। যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামেই বাংলাদেশের মানুষ জানে। যেই মামলায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান করে ৩৫ জনকে আসামি করা হয়েছিল।

নূর মোহাম্মদ ক্যাপ্টেন বাবুল মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ৯ নম্বর সাব সেক্টরের (বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চল) যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন।

আমরা বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা এ মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় ও স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহের কথা জানাব...

জন্ম ও ব্যক্তিপরিচয়
নূর মোহাম্মদ ক্যাপ্টেন বাবুল ১৯৩৪ সালের ২ জানুয়ারি মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানার অন্তর্গত কুমারভুক গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেন। তাঁর বাবা তমিজউদ্দিন আকন ছিলেন একজন কাপড় ব্যবসায়ী। মা রাবেয়া খাতুন ছিলেন গৃহিণী। তিনি স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন। পরে তাঁর বাবা ব্যাবসায়িক উদ্দেশে ফরিদপুরে এলে তারাও ফরিদপুরে চলে আসেন এবং জেলা শহরের গোয়ালচামট এলাকায় বসবাস করতে থাকেন।

পরে নূর মোহাম্মদ বাবুল শহরের হিতৈষী স্কুলে ভর্তি হয়ে সেখান তিনি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। অতঃপর ফরিদপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে ১০ শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে নৌবাহিনীর নাবিক পদে চাকরি হয় তাঁর। ছাত্রজীবনে তাল ও কলা পাতায় পুঁই গাছের পাকা ফল দিয়ে লিখে পড়াশোনা করতেন। পরে চাকরিতে থাকাকালীন সময়ে ১৯৫৩ সালে করাচি বোর্ডের অধীনে এসএসসি  পাস করেন যুদ্ধকালীন এ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার।



নৌবাহিনী চাকরিকালীন সময়
নৌবাহিনীতে চাকরিকালীন সময়ে পদোন্নতি পেয়ে নূর মোহাম্মদ বাবুল নাবিক থেকে ‘পিটি অফিসার’ হন। পিটি অফিসার থাকাকালীন সময়ে নাবিকদের প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি। চাকরির সময়ে তাঁর সাহসিকতার বিষয়টি পুরো নৌবাহিনীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। চাকরির সুবাদে দেশ-বিদেশেও ভ্রমণ করার সুযোগ হয় তাঁর। ১৯৬৯ সালে চাকরি থেকে অবসর নেন এ মুক্তিযোদ্ধা।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা 
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে দায়ের করা একটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগ নেতা ও পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন প্রখ্যাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করেছিল। ১৯৬৮ সালের প্রথম ভাগে দায়ের করা এই মামলায় অভিযোগ করা হয় যে, শেখ মুজিব ও অন্যরা ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই মামলাটির পূর্ণ নাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য মামলা’। যাকে ‘স্টেট ভার্সেস শেখ মুজিব অ্যান্ড আদারস’ নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। এ মামলায় ৫ নম্বর আসামি করা হয় নূর মোহাম্মদ বাবুলকে। তখনকার রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার শাস্তি ছিল আসামিকে গুলি করে হত্যা করা।



সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা 
মুক্তিযুদ্ধের আগে ক্যাপ্টেন বাবুলসহ নৌবাহিনীর একটি টিম মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে গিয়ে পরাধীনতার শিকল ভেঙে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীনতার কথা বলেন। তবে মওলানা ভাসানী সমর্থন জানালেও তিনি তখন বলেছিলেন, ‘আমারতো বয়স হয়েছে, তাই তোমরা শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করো। সেই পারবে এর নেতৃত্ব দিতে। তখন তারা, ভারতে গিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বাসায় থাকা শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন এবং সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশ স্বাধীনতার কথা বুঝিয়ে বলেন। কথা শুনে ‘শেখ মুজিব’ একাত্মতা প্রকাশ করেন। তখন মুজিবের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা করা হয়।  

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও যুদ্ধ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদেশে তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুর তবে বর্তমান গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ভাটিয়াপাড়া, ওড়াকান্দি, রামদিয়া কলেজ, যেতুকান্দি, ওরাকান্দির ঠাকুরবাড়ী এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হয় নূর মোহাম্মদ বাবুলের নেতৃত্বে গঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের। নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের ওড়াকান্দি স্কুল মাঠে প্রশিক্ষণও দিতেন নূর মোহাম্মদ। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চিরা, মুড়ি, গুড়সহ শুকনো খাবার খেয়ে যুদ্ধ করতেন তারা। কখনো পাঁচ-সাতদিন পরও ভাত খেয়েছেন।

স্বাধীনতা পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠা
আগামী প্রজন্মকে জাতির এ গৌরবের ইতিহাস জানাতে ও মহান মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন সংরক্ষণ এবং প্রদর্শনের নিমিত্তে মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার নূর মোহাম্মদ বাবুল যুদ্ধ শেষে নিজ বাড়ি ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট এলাকায় ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিরল ছবি, বইসহ নানা নিদর্শন শোভা পাচ্ছে। তবে, যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে মুক্তিযুদ্ধের এসব নিদর্শনগুলো ধুলা-ময়লা ও পোকামাকড় নষ্ট করে ফেলছে।  

তবে, ওপর মহলের বারবার আশ্বাস পেলেও এ জাদুঘর ও পাঠাগার যথাযথভাবে সংরক্ষণে মেলেনি কোনো আর্থিক সহযোগিতা কিংবা কোনো উদ্যোগ। এতে মুক্তিযুদ্ধের বিরল এ নিদর্শন বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন নূর মোহাম্মদ বাবুল ও তার পরিবার। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ নানা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন থেকে ৭০ এর অধিক সম্মাননা, ক্রেস্ট এবং নানা পুরস্কার পেলেও এখনও পর্যন্ত পাননি রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা কিংবা একুশে পদক।  

এ প্রসঙ্গে নূর মোহাম্মদ ক্যাপ্টেন বাবুল বাংলানিউজকে বলেন, ‘পুরস্কারের জন্য এ দেশ স্বাধীন করেনি। তাইতো, আমি কখনো স্বাধীনতা পদকের জন্য আবেদন করিনি। আমার দেশের কাছে পুরস্কার চেয়ে নিতে হবে কেন? 



‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন কী চান?’ এমন মন্তব্য করে যুদ্ধকালীন এ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বলেন, আমি তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরাসরি না করে দিয়ে বলেছিলাম, ‘কোনো পুরস্কার পাওয়ার আশায় আমি যুদ্ধ করেনি। আমি কিছু চাই না। ’ আমাদের দেশের মানুষ যাতে ভালো থাকতে পারে, সুখে থাকতে পারে সেটাই আমি চেয়েছিলাম। আর এখনতো সবাই স্বার্থ, টাকা আর সুবিধা পাওয়ার জন্য সবকিছু করছে।

এ সব ব্যাপারে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. কামরুল আহসান তালুকদার বাংলানিউজকে বলেন, ফরিদপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ ক্যাপ্টেন বাবুল। মুক্তিযুদ্ধে বিরাট অবদান রয়েছে তার। তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ছিলেন, কারাবন্দি ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি এই ফরিদপুরের মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে কাজ করছেন। তার একটি পাঠাগার ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর রয়েছে। তার পাঠাগারে মুক্তিযুদ্ধের বিরল কিছু ছবি ও বই রয়েছে। আমরা খুব তাড়াতাড়ি এ জাদুঘর ও পাঠাগারটি পরিদর্শন করব।  

কামরুল আহসান আরও বলেন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নিচতলায় একটি স্মৃতি জাদুঘর রয়েছে, সেখানে নূর মোহাম্মদ ক্যাপ্টেন বাবুলের ব্যবহৃত ও দুর্লভ যেসব জিনিসপত্র রয়েছে, সেগুলো আমাদের এ জাদুঘরে যুক্ত করব। তাহলে ফরিদপুরবাসী এগুলো দেখার সুযোগ পাবে, একই সঙ্গে তার যে বীরত্ব ও বীরত্বপূর্ণ অবদান ফরিদপুরবাসী জানতে ও নতুন প্রজন্মকে জানাতে সক্ষম হবো।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০২৪
এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।