ফরিদপুর: চাঁদা না দেওয়ায় তার দুই সন্তানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লীতে নিহত দুই সহোদরের বাবা শাহজাহান খান।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ঘটনার দিন প্রথমে আমার ছেলেদের মারধর শুরু করেন ডুমাইন ইউপি চেয়ারম্যান শাহ্ মো. আসাদুজ্জামান তপন।
ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার নওপাড়া ইউনিয়নের চোপেরঘাট এলাকায় নিহত দুই ভাইয়ের বাড়িতে গেলে তাদের বাবা শাহজাহান খান এ অভিযোগ করেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি জানান, আগামী ঈদুল আযহার পর বিয়ে করে ঘরে বউ আনার কথা ছিল বড় ছেলে আশরাফুলের। সেজন্য স্থানীয় এনজিও থেকে কিস্তিতে ঋণ নিয়ে ঘরও নির্মাণ করেছিল সে। কিন্তু সেই আশা আর পূরণ হলো না। গণপিটুনিতে নিহত হতে হলো তাকে।
শাহজাহান খান বলেন, এক স্ত্রী, চার ছেলে ও এক মেয়েসহ সংসারটি কোনোরকম চলছিল। বড় ছেলে আশরাফুল খান (১৯) ও মেজো ছেলে এরশাদুল খান (১৫) মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার পাল্লা শিরগ্রামে একটি কওমি মাদরাসায় হাফেজি পড়ছিল। এরপর মহামারি করোনার সময় মাদরাসা বন্ধ হয়ে যায়। আশরাফুল ২২ পারা ও এরশাদুল ১২ পারার কোরআন মুখস্থ করেছিল। কিছুদিন পরেই নওপাড়া ইউনিয়নের আমডাঙ্গা গ্রামের ঠিকাদার জালালের সঙ্গে বড় ছেলে আশরাফুল রাজমিস্ত্রির কাজে যোগ দেয়।
তিনি আরও বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে জালালের ফার্মে কাজ করছিল আশরাফুল। এর মাঝে মেজো ছেলে এরশাদুল বড় ভাই আশরাফুলের সঙ্গে রাজমিস্ত্রীর কাজ শুরু করে। এর ৪ মাস আগে আমার উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন নসিমনটি বাড়ি থেকে চুরি হয়ে যায়। এরই মাঝে বড় ছেলেসহ পরিবারের লোকজনের আলোচনা হয় তাকে কোরবানির ঈদে বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে।
তিনি বলেন, আশরাফুল এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে টিনসেড ছোট্ট একটি ঘর নির্মাণ করে। তারা দুই ভাই কাজ করছিল আর প্রতি সপ্তাহে ঋণের কিস্তি দিয়ে আসছিল। হত্যাকাণ্ড ঘটনার কিছুদিন আগে এক ছেলে আমাদেরকে মোবাইলে জানিয়েছিল সেখানে ঝামেলা চলছে স্কুলের কাজ নিয়ে। স্থানীয় মেম্বার অজিত মণ্ডল কাজ থেকে টাকা চেয়েছিল, এনিয়ে তাদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হয়।
এদিকে শ্রমিকদের গণপিটুনির ঘটনায় ১৫ ও ৪৩ সেকেন্ডের দুটি ভিডিওক্লিপ গত ২১ এপ্রিল সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
এতে দেখা যায়, এক ব্যক্তিকে স্কুলের কক্ষে মেঝেতে ফেলে পেটানো হচ্ছে। এ সময় ডুমাইন ইউপি চেয়ারম্যান শাহ্ মো. আসাদুজ্জামান তপন ও ইউপি সদস্য অজিত কুমার বিশ্বাসকে মারধরে অংশ নিতে দেখা যায়। এদিকে ওই ভিডিও প্রকাশের পর ইউপি চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান তপন ও মেম্বার অজিত বিশ্বাস গা ঢাকা দিয়েছেন।
এব্যাপারে ফরিদপুরের সহকারী পুলিশ সুপার (মধুখালী সার্কেল) মো. মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, পঞ্চপল্লীর কালি মন্দিরের আগুনের গুজবের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪টি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে এ পর্যন্ত ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ফরিদপুরের পুলিশ সুপার (এসপি)) মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বাংলানিউজকে বলেন, দুই শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে। এ ঘটনায় জড়িতের অভিযোগ ওঠা ডুমাইন ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের মেম্বারকেও গ্রেপ্তারে পুলিশের কয়েকটা টিম কাজ করছে। আশা করছি, অল্প সময়ের মধ্যে তাদের আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হব।
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. কামরুল আহসান তালুকদার বাংলানিউজকে বলেন, পঞ্চপল্লীর কালি মন্দিরে আগুনের ঘটনায় তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রথমে তিনদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের কথা থাকলেও ভিকটিমরা ঢাকা ও গাজীপুর চিকিৎসা নিচ্ছেন। তদন্ত কমিটি সেখানে গিয়ে রোগীদের সঙ্গে কথা বলছেন। এ জন্য তদন্ত রিপোর্ট প্রদানের সময় বাড়িয়ে সাতদিন করা হয়েছে।
ডিসি বলেন, নিহতের পরিবারকে দাফন-কাফনের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ধর্মমন্ত্রী ১ লাখ করে নিহত দুই ভাইয়ের জন্য দুই লাখ এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় দুই লাখ টাকা প্রদান করেছেন। তাছাড়াও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নিহতের পরিবারকে একটি ঘর ও একটি নসিমন গাড়ি কিনে দিতে চেয়েছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবারও দেওয়া হয়েছে। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় সাহায্য করতে পাশে আছে জেলা প্রশাসন।
প্রসঙ্গত, গত ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন একটি কালি মন্দিরের প্রতিমায় আগুনের খবর পেয়ে জড়ো হন এলাকাবাসী। এ ঘটনায় ওই বিদ্যালয়ে নির্মাণ কাজ করা ৭ শ্রমিককে সন্দেহ করেন স্থানীয়রা। পরে স্কুলে গিয়ে তাদের অবরুদ্ধ করে বেঁধে মারধর করা হয়। এতে গুরুতর আহত হলেও শ্রেণিকক্ষে আটকে রাখা হয়। প্রথমে থানা পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন চেষ্টা করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হন। পরে জেলা পুলিশ ও প্রশাসনের অতিরিক্ত সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে শাহজাহান খানের দুই ছেলে আশরাফুল ও এরশাদুলকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০২৪
এসএএইচ