ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ল্যাব থাকলেও টেকনিশিয়ান নেই লালমনিরহাট জেলা পশু হাসপাতালে

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১০ ঘণ্টা, মে ৫, ২০২৪
ল্যাব থাকলেও টেকনিশিয়ান নেই লালমনিরহাট জেলা পশু হাসপাতালে

লালমনিরহাট: গবাদিপশু-পাখির রোগ নির্ণয়নের জন্য জেলা ও উপজেলা পশু হাসপাতালে ল্যাব থাকলেও তা টেকনিশিয়ানের অভাবে কোনো কাজেই আসছে না। দীর্ঘদিন ব্যবহার না করায় নষ্ট হচ্ছে ল্যাবের কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ও কিট।

জানা গেছে, প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে প্রতিটি জেলায় জেলা ও উপজেলাগুলোতে উপজেলা পশু হাসপাতাল গড়ে তুলেছে সরকার। ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা জেলা লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলায় পাঁচটি উপজেলা পশু হাসপাতাল ও জেলায় একটি জেলা পশু হাসপাতাল রয়েছে। মাংস, ডিম ও দুধ উৎপাদন বাড়াতে এসব পশু হাসপাতাল গড়ে উঠে খামারি ও উদ্যোক্তাদের জন্য। চাহিদা বিবেচনায় বর্তমানে খামার গড়ে তুলে নিজেকে স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছেন খামারিরা।  

এসব খামারিদের হাতের কাছে গবাদিপশু-পাখির বিভিন্ন রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় হাসপাতালগুলোর অবদান অনেক। হাসপাতালগুলোতে ওষুধ ও ভ্যাক্সিনও দেওয়া হচ্ছে। এজন্য প্রতিটি হাসপাতালে বার্ষিক কয়েক লাখ টাকার ওষুধ দেওয়া হচ্ছে সরকারিভাবে। কিছু ওষুধ ও ভ্যাক্সিন ফ্রিতে আবার কিছু স্বল্প মূল্যে খামারিদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে সরকার। বিভিন্ন রোগ নির্ণয়নে হাসপাতালগুলোতে ল্যাবও দেওয়া রয়েছে। এসব ল্যাবে কোটি টাকার যন্ত্রাংশসহ কিট রয়েছে। কিন্তু এ ল্যাব পরিচালনায় ল্যাব টেকনিশিয়ান পদ থাকলেও অধিকাংশই শূন্য রয়েছে। ফলে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করা যাচ্ছে না কোনো যন্ত্রপাতি। ফলে অযত্ন আর অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার সরকারি সম্পদ। কিছু হাসপাতালে ভেটেনারি সার্জনরাই ল্যাবে অতিরিক্ত কাজ করে জনগণকে সেবা দিচ্ছেন। তবে তার সংখ্যা অনেক কম।  

আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন থাকলেও নেই দক্ষ জনবল। ফলে অযত্নে নষ্ট হচ্ছে এসব মূল্যবান যন্ত্রাংশ। বর্তমানে কয়েকটি উপজেলা ভেটেনারি সার্জনদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে এসব আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন সচল রাখার ব্যবস্থা করছে সরকার। তবে এ সেবা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি জেলার ছয়টি হাসপাতালে। বর্তমানে তাপপ্রবাহে অনেক গবাদিপশু-পাখি নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। চিকিৎসার জন্য খামারিরা পশু হাসপাতালে ভিড় করছেন। প্রায় প্রতিটি হাসপাতালে ৭০ শতাংশ জনবলের সংকট রয়েছে। ফলে কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।  

জেলা পশু হাসপাতালে একজন ভেটেরিনারি সার্জনসহ সাতটি পদ থাকলেও পদায়ন রয়েছে মাত্র চারজনের। এর মধ্যে একজন উপসহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা। তাকে দিয়ে করানো হচ্ছে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয়ের অফিস সহকারীর কাজ। জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় ও পশু  হাসপাতালে সাতটি অফিস সহকারীর পদে একজনও নেই। সাতটি পদই শূন্য রয়েছে। জনবল সংকটের কারণে সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন জেলার খামারিরা। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কতিপয় কর্মকর্তা বখশিস নামে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছেন বলেও অভিযোগ খামারিদের। বখশিস না দিলে পরবর্তী দিনে সেবা দিতে অনীহা প্রকাশ করেন এসব কর্মকর্তা।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক খামারি বলেন, গরু হাসপাতালে নেওয়ার সুযোগ কম। তাই ভেটেরিনারি সার্জন বা সংশ্লিষ্টদের খামারে ডাকলে বখশিস দিতে হয়। সেটা অফিস সময় হোক বা অফিসের সময়ের বাইরে হোক। বখশিসের নামে টাকা না দিলে পরে কোনো সেবাই মিলবে না। তাই বাধ্য হয়ে দিতে হচ্ছে। সরকারি ওষুধের জন্যও টাকা গুণতে হয়। প্রাণিসম্পদ বিভাগের অনীহায় উন্নতি হচ্ছে না খামারিদের।  

জেলা পশু হাসপাতালে একমাত্র ভেটেরিনারি সার্জন ডা. বজলুর রশিদ। তিনি একাই মাঠে খামারিদের ও  হাসপাতালের একমাত্র চিকিৎসক। পশু হাসপাতালের ল্যাব টেকনিশিয়ান না থাকায় তিনি ল্যাব টেকনিশিয়ানের কাজটিও করছেন। তবে বেশিরভাগ সময় তিনি মাঠেই খামারিদের সেবা দেন। ফলে হাসপাতালে আসা খামারিরা সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রায় দিনই হাসপাতালে পশু নিয়ে এসে ফিরে যাচ্ছেন অনেকে।  

গত মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বেলা ৩টার দিকে জেলা পশু হাসপাতালে শখের টিয়া পাখি নিয়ে আসেন জেলা শহরের আপন পাড়ার সোহেল রানা। এসে দেখেন হাসপাতালের সব দরজায় ঝুলছে তালা। দুই হাজার দুইশ টাকায় কেনা শখের টিয়া পাখির বাচ্চাটি অসুস্থ। তাই ছুটে এসে হাসপাতালে তালা দেখে হতাশায় পড়েন তিনি। অবশেষে এ প্রতিবেদকের ফোনে হাসপাতালে আসেন ভেটেরিনারি অফিসার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ডা. হেলাল উদ্দিন খান। পরে তিনি চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ দিয়ে বিদায় দেন সোহেল রানাকে।  

এ সময় সোহেল রানা বলেন, অনেক শখ করে উন্নত জাতের টিয়া পাখি পালন করছি। সেই পাখি দিনভর কিছু না খাওয়ায় অসুস্থ হলে জেলা পশু হাসপাতালে ছুটে এসেছি। কিন্তু এসে দেখি, হাসপাতালে কেউ নেই। জেলা হাসপাতালের এমন অবস্থা হলে উপজেলা পশু হাসপাতালের কি অবস্থা, তা এমনিই বোঝা যায়। সেবা না দিলে এমন হাসপাতালের প্রয়োজন কি? 

জেলা পশু হাসপাতালের ভেটেরিনারি সার্জন ডা. বজলুর রশিদ বলেন, একমাত্র চিকিৎসক হিসেবে বাইরের খামারে যেতে হয় এবং হাসপাতালও দেখতে হয়। হাসপাতালে চিকিৎসক ও ল্যাব টেকনিশিয়ানের কাজও করতে হয়। এমনকি অফিস পরিষ্কারের কাজটিও আমাকে করতে হয়। তিনজনের কাজ একাই করা কীভাবে সম্ভব? তাই সবটাই জোড়াতালি দিয়ে করার চেষ্টা করছি। যা অত্যন্ত কষ্টকর। প্রয়োজনীয় জনবল দিলে উপযুক্ত সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।  

জেলা পশু হাসপাতালের ভেটেরিনারি অফিসার (অতি.) ডা. হেলাল উদ্দিন খান বলেন, অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও নেই চালক, ল্যাব থাকলেও নেই টেকনিশিয়ান। একজন ভেটেরিনারি সার্জন দিয়ে বাইরে ও হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া বেশ কষ্টকর। বাইরে গেলে হাসপাতাল চিকিৎসক শূন্য থাকে। জেলা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রে ছয়টি পদের চারটিই শূন্য। এভাবে উপযুক্ত সেবা দেওয়া বেশ কষ্টকর হচ্ছে। অফিস সময়ে হাসপাতালে বা বাইরে সেবা দিয়ে কেউ টাকা নিয়েছেন- এর প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, জনবল সংকটের কারণে সেবা দেওয়া কষ্টকর হচ্ছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩০৬ ঘণ্টা, মে ০৫, ২০২৪
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।