পাথরঘাটা (বরগুনা): পূর্বে বিষখালী ও পশ্চিমে বলেশ্বর নদ এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর বেষ্টিত পাথরঘাটা উপজেলা। এখানকার অধিকাংশ মানুষের বসবাস নদী ও খালের পাড়ে।
বলছি বরগুনার পাথরঘাটা উপকূলের মানুষের জীবন যাত্রার কথা। যেখানে পানিতে ডুবে দুর্ঘটনার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। সেখানে নেই কোনো ডুবুরি ইউনিট। এতে ব্যাহত হয় উদ্ধার অভিযান। পানিতে ডুবে যাওয়া কাউকে সম্ভব হয় না জীবিত উদ্ধার করা। তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার অভিযান শুরু না হওয়ায় অনেক সময় মরদেহ উদ্ধারেও বেগ পেতে হয়। খবর পেয়ে বরিশাল থেকে ডুবুরি দল আসতে আসতে নিখোঁজ নয়তো মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে ডুবুরি দলের দাবি করে আসছে এ উপকূলের সচেতন মহল। তবে উপজেলা প্রশাসন থেকে ডুবুরি দল পদায়নের জন্য একটি প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বরগুনা জেলায় অন্তত ৩০০ কিলোমিটার নৌপথ রয়েছে। এতে পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি প্রতিদিন হাজার হাজার স্থানীয় বাসিন্দারা চলাচল করেন। এছাড়াও উপজেলা শহর থেকে জেলা শহরে যাতায়াতের জন্য বেশিরভাগই খেয়া পারাপার হচ্ছে। এছাড়া এ জেলায় জেলে রয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার। নদী কেন্দ্রিক জীবন-জীবিকার পাশাপাশি নৌপথে চলাফেরার কারণে জেলা এবং উপজেলায় প্রায়ই পানিতে ডুবে নিখোঁজের ঘটনা ঘটে। খাল, বিল এবং পুকুরে ডুবে যাওয়ার ঘটনা তো রয়েছেই।
এসব ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে ভুক্তভোগীদের জীবিত উদ্ধারে দরকার পড়ে ডুবুরিদের। কিন্তু বরগুনার পাথরঘাটায় কোনো ডুবুরি ইউনিট না থাকায় বরিশাল থেকে ডুবুরি আনতে হয়। ফলে ডুবুরি আসতে আসতে পানির মধ্যে প্রাণ হারান ভুক্তভোগীরা। এছাড়া ডুবুরির অভাবে যথাসময়ে উদ্ধার অভিযান শুরু না হওয়ায় বেগ পেতে হয় মরদেহ উদ্ধারেও।
বরগুনা জেলা সিভিল সার্জন অফিসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বরগুনায় ২০১৮ সালে ২৫, ২০১৯ সালে ৩৪, ২০২০ সালে ২৮, ২০২১ সালে ১৬, ২০২২ সালে ১০ ও ২০২৩ সালের চলতি মে মাস পর্যন্ত তিনজনসহ মোট ১১৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বরিশাল বিভাগের মধ্যে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি বরগুনায়। এর মধ্যে পাথরঘাটার সংখ্যাও কম নয়।
পাথরঘাটা ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন অফিসার রফিকুল ইসলাম বলেন, পাথরঘাটা একটি নদী বেষ্টিত উপজেলা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবন এলাকা। এখানে প্রতিনিয়ত দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতিসহ পানিতে ডুবে প্রাণহানিও ঘটে। এখানে ডুবুরি টিম দেওয়া হলে আমাদের কাজ যেমন সহজ হবে তেমনি দ্রুততার সঙ্গে উদ্ধার অভিযানে প্রাণহানির ঘটার সম্ভাবনা কমে যাবে।
তিনি আরও বলেন, বরগুনার ছয় উপজেলায় ছয়টি ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্স স্টেশন থাকলেও এর একটিতেও ডুবুরি ইউনিট নেই। জেলার কোথাও পানিতে নিখোঁজের ঘটনা ঘটলে বরিশাল থেকে ডুবুরি আনতে হয়। এতে ভুক্তভোগীকে আর জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। এছাড়া নদীতে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। তখনও তাৎক্ষণিক ডুবুরির প্রয়োজন হয়।
পাথরঘাটা উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বায়ক সাংবাদিক ও গবেষক শফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, পাথরঘাটায় দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র হওয়ায় বেশিরভাগ মানুষের জীবিকা নদী ও সাগর কেন্দ্রিক। এ কারণে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস উপেক্ষা করে জীবন-জীবিকার জন্য ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। তাদের নেই কোনো লাইফ জ্যাকেট বা লাইফ সাপোর্টের জন্য সামগ্রী। ফলে প্রতি বছর কমবেশি দুর্ঘটনা ঘটে এবং মৃত্যু হয়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছি ডুবুরি দলের জন্য।
তিনি আরও বলেন, উপকূল রক্ষা করতে হলে শুধু যে বন, বন্যপ্রাণী, নদ-নদী রক্ষা করতে তাই নয়। মানুষকেও রক্ষা করতে হবে। উপকূল রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে ডুবুরি দলের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে অনেক।
পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রোকনুজ্জামান খান বলেন, সাগর ও নদীতে প্রতি বছর কমবেশি জেলে নিখোঁজ হয় এবং মারাও যায়। গত ১০ দিনে পানিতে ডুবে তিন জন মারা যায়, তার মধ্যে একজন শিশু। ডুবুরি না থাকায় যথাসময়ে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। বরিশাল বিভাগে কেবল বরিশাল এবং পটুয়াখালী জেলায় ডুবুরি টিম রয়েছে যা অত্র উপজেলা থেকে বেশ দূরবর্তী হওয়ায় জরুরি উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হয় এবং মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
এজন্য উপজেলা প্রশাসন থেকে ৫মে পাথরঘাটা উপজেলার ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনে জরুরি ভিত্তিতে একটি ডুবুরি টিম পদায়নের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অগ্নি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিবের কাছে চিঠি পাঠিয়েছি।
এ বিষয়ে বরগুনা-২ আসনের সংসদ সদস্য সুলতানা নাদিরা বলেন, পাথরঘাটার চারপাশেই নদী-খাল। প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। ডুবুরি দলের জন্য ইতোমধ্যেই জাতীয় সংসদে ৭১ বিধিতে আনা হয়েছে এবং এ সপ্তাহের মধ্যেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গিয়ে এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থাগ্রহণ করবো।
বাংলাদেশ সময়: ১২০১ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০২৪
এসএম