লক্ষ্মীপুর: জেলা শহরের সংযোগ সড়ক সম্প্রসারণে প্রায় সাড়ে ৩২ কোটি টাকার কাজে চরম অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে ঠিকাদার ইস্কান্দার মির্জা শামীমের বিরুদ্ধে। সওজের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে অতি নিম্নমানের কাজ ও শিডিউল বহির্ভূতভাবে করছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
পরে জনগণের রোষানলে পড়ে কাজ বন্ধ করে দেয় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার। জনরোষের মধ্যেও পড়েছে সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা। অনিয়মের তদন্তে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ কাজের ত্রুটি পেয়েছে বলেও গণমাধ্যমকর্মীদের নিশ্চিত করেছে।
এদিকে অনিয়মের অভিযোগ উঠায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে, নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় কাজে লোকসান হচ্ছে তাদের। জেলা প্রশাসক ও সড়ক বিভাগের অনুরোধে লস দিয়ে কাজটি করে যাচ্ছেন তারা।
শিডিউল অনুযায়ী কাজটি সম্পন্ন করতে হস্তক্ষেপ করেছে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসন। রোববার (২ জুন) রাত ১০টার দিকে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুরাইয়া জাহানের উপস্থিতিতে ফের কাজ শুরু হয়। রাত ১টার দিকেও কাজের তদারকি করেছেন তিনি।
এর আগে একই দিন সন্ধ্যায় লক্ষ্মীপুর আদর্শ সামাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ডিসিসহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) এবি ছিদ্দিক, সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম সালাহ উদ্দিন টিপু এক জরুরি বৈঠক করেন।
বৈঠক শেষে ডিসি ও এএসপি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, সড়কটি ১৫০ মিলিমিটার কার্পেটিং হবে। অনিয়মের সুযোগ নেই। সর্বোচ্চ তদারকির মাধ্যমেই কাজ সম্পন্ন হবে। এতে জেলা প্রশাসন, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি ও সওজের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা তদারকি করবেন।
অন্যদিকে সড়ক উন্নয়ন কাজে লক্ষ্মীপুর সওজের তদারকি নেই বলে অভিযোগ বাজার ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের। ঠিকাদারের সঙ্গে অনৈতিক যোগসাজশে সওজ বিভাগ নীরব ভূমিকা পালন করছে।
সড়কের দু’পাশে ছয় ফুট করে ১২ ফুট ড্রেন নির্মাণ করার কথা থাকলেও তা তিন ফুটে এসে দাঁড়িয়েছে। আবার সড়কের তমিজ মার্কেট এলাকায় পুরাতন ড্রেনের সঙ্গে নতুন ড্রেন সংযুক্ত করে দিয়েছে। সড়কটির চৌধুরী সুপার মার্কেট এলাকায় মাঝখানে বৈদ্যুতিক খুঁটি রেখেই ড্রেন নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে।
এ নিয়ে রোববার (২ জুন) সওজ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর বক্তব্য জানতে গেলে তিনি দায়সারা বক্তব্য দেন। তার দাবি, ঠিকাদারকে অনুরোধ করে কাজটি সম্পন্ন করাচ্ছেন তিনি।
সওজ বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৩২ কোটি ৬৩ লাখ ৬৭ হাজার টাকা ব্যয়ে লক্ষ্মীপুর শহর সংযোগ সড়কটির দক্ষিণ তেমুহনী থেকে উত্তর তেমুহনী ও ঝুমুর থেকে সওজ কার্যালয় পর্যন্ত ২০২০ সালে ১৯ ডিসেম্বর কাজ শুরু হয়। এ কাজটি যৌথভাবে (জয়েন্ট ভেঞ্চার) পেয়েছেন এমএম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড ও মেসার্স সালেহ আহমেদ। এর প্রধান হলেন ইস্কান্দার মির্জা শামীম।
২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার কথা থাকলেও তা হয়নি। এরমধ্যে তিন বার প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। ২০২৪ সালে এসে শহর সংযোগ (দক্ষিণ তেমুহনী-উত্তর তেমুহনী) সড়কের কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া ফুটপাতের জন্য ১৭ কোটি ৮১ লাখ এক হাজার ৬১৪ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। মাটি কাটার জন্য বরাদ্দ হয় দুই কোটি ৭২ লাখ ৯২ হাজার ২৭১ টাকা।
জানা গেছে, প্রকল্পটিতে সড়কটি ৩৬ ফুট প্রশস্ত হবে। একই সঙ্গে সড়কের দুই পাশে ছয় ফুট করে ড্রেন নির্মাণের বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু জায়গায় নির্দিষ্ট পরিমাপে ড্রেন নির্মাণ হয়নি।
সড়কে ৮০ শতাংশ পাথর ও ২০ শতাংশ বালু দেওয়ার কথা থাকলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তার উল্টো কাজ করছেন। তারা ২০ শতাংশ পাথর কমিয়ে বালু দিয়ে সাব গ্রেড তৈরি করছে। এছাড়া সাব গ্রেড তৈরির পর কার্পেটিংয়ের জন্য ৪৫ দিন অপেক্ষা করতে হলেও তা করা হয়নি। সাবগ্রেড তৈরির দুদিন না যেতেই কার্পেটিংয়ের কাজ শুরু করা হয়।
নিয়ম অনুযায়ী কাজ না হওয়ার দাবি তুলে বাজার ব্যবসায়ী ও স্থানীয় জনগণ শুক্রবার (৩১ মে) রাতে লক্ষ্মীপুর আদর্শ সামাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে চলমান কাজ বন্ধের জন্য দাবি জানান।
খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সালাহ উদ্দিন টিপু ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেন। তবে সওজ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কেউই তাকে বিস্তারিত কোনো তথ্য উপস্থাপন করেনি। পরে সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম এসে কাজ বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। এরপর থেকে দু’দিন কাজ বন্ধ ছিল।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার তারেক আজিজ বলেন, সড়কের কাজে কোনো দুর্নীতি হচ্ছে না। মানুষ না বুঝেই অভিযোগ তুলছে। নিম্নমানের কোনো পাথরও ব্যবহার করা হচ্ছে না। সড়কের জেন্টাল পার্ক, নুরুল ইসলাম চত্বর, মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটসহ বিভিন্ন স্থানে এখনও ভবন অপসারণ করা হয়নি। ভবন না ভাঙলে আমরা জায়গা পাবো কোথায়? এজন্য যতটুকু জায়গা পেয়েছি, ততটুকুতেই কাজ চলমান রয়েছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী ইস্কান্দার মির্জা শামিম মুঠোফোনে বলেন, প্রাক্কলনটি ছিল ২০১৮ সালের। তখনকার মালামালের মূল্য ছিল কম। জমি অধিগ্রহণে দুই বছর চলে যায়। এরই মধ্যে মালামালের দাম বেড়ে গেলে কাজে অনাগ্রহ প্রকাশ করি। এরপরও কর্তৃপক্ষের অনুরোধে কাজ শুরু করি। কাজ করতে গিয়ে আমাকে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। এতে কাজটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলি। পরে জেলা প্রশাসন ও সওজ বিভাগের অনুরোধে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এ কাজে আমার লোকসান হবে।
সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম সালাহ উদ্দিন টিপু বলেন, কাজের মান নিয়ে জনরোষের খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে যাই। জানতে চাইলেও কর্তৃপক্ষ আমাকে কিছু জানাইনি।
লক্ষ্মীপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম বলেন, নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে সড়ক উন্নয়নের কাজ চলছে।
তিনি বলেন, তদন্তে গিয়ে কিছু ত্রুটি পাওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে তা সংশোধন করতে বলা হয়েছে। সেসব ত্রুটি সম্পন্নের জন্যই কাজ বন্ধ করা হয়েছিল।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান বলেন, কাজ নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ উঠায় আমি সড়ক উন্নয়ন কাজ এলাকায় এসেছি। সওজের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা হয়েছে। সঠিকভাবে তদারকির মাধ্যমেই নির্দিষ্ট নিয়মে কাজ সম্পন্ন হবে। কোনো ধরনের দুর্নীতি করার সুযোগ নেই। কাজটি যাতে মানসম্মত হয়, আমি নিজেও তদারকি করবো।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩২ ঘণ্টা, জুন ৩, ২০২৪
এসএম