ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

কোটা আন্দোলনে নিহত ডা. সজিব

‘কী দোষ ছিল আমার ডাক্তার ছেলের?’

সুজন বর্মণ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০০ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০২৪
‘কী দোষ ছিল আমার ডাক্তার ছেলের?’

নরসিংদী: গত ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে ‘কমপ্লিট শাটডাউনের’ মধ্যে মাদরাসা পড়ুয়া ছোট ভাইকে নিতে নরসিংদী থেকে ঢাকায় আছেন ডা. সজীব সরকার। এসময় ঢাকার উত্তরার আজমপুরে পৌঁছলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী আর পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে গেলে গুলিতে নিহত হন তিনি।

সংসারে উপার্জন সক্ষম ছেলেকে হারিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন শয্যাশায়ী মা ঝর্ণা বেগম (৫৬)। এ সময় তিনি জানান, দীর্ঘদিন যাবত অসুস্থ তিনি। সবসময় তাকে ছোট্ট সন্তানের মত আগলে রাখতো। তিনিসহ সবার খরচ চালাত সজীব। এখন কে আমাকে আগলে রাখবে বলে আবারও মূর্ছা যাচ্ছেন আর বলছেন ‘কী দোষ ছিল আমার ডাক্তার ছেলের?’

নিহত ডা. সজিব নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের মেঝেরকান্দি গ্রামের মো. হালিম সরকারের ছেলে। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র লেকচারার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন ডা. সজীব।

মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) বিকেলে নরসিংদী জেলা শহরের তরোয়া এলাকায় নিহত ডা. সজীবের ভাড়া বাড়িতে মা ঝর্ণা বেগমের সঙ্গে কথা হয়।

এ সময় তিনি বলেন, গত ১৮ জুলাই আমার ছোট ছেলে আবদুল্লাহকে আনতে বেলা ১১টায় বাসা থেকে বের হন সজিব। পরে বিকেল সাড়ে ৪ থেকে ৫টার দিকে আমাকে ফোন করে বলে ‘মা আমি আজমপুর পৌঁছে গেছি আর কয়েক মিনিটের মধ্যে আব্দুল্লাহর মাদরাসায় পৌঁছে যাব তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমি আব্দুল্লাহকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিয়ে চলে আসব’। তারপর থেকে রাত ১টা পর্যন্ত ছেলের অপেক্ষায় বসে ছিলাম। ছেলে আমার ফিরে এসেছে ঠিকই তবে জীবিত নয় লাশ হয়ে। বলতে পারেন- কি দোষ ছিল আমার ছেলের?’ 

তিনি আর বলেন, ছেলেকে ডাক্তার বানাতে আমাদের যা ছিল সব ব্যয় করেছি। এখন আমরা নিঃস্ব হয়ে গেলাম। আমার ছেলে হত্যার বিচার কি ভাবে পাবো? বলেই তিনি আবারও মূর্ছা যান।

এসময় কথা হয় এমবিএ পড়ুয়া ডা. সজীব সরকারের একমাত্র বোন সুমাইয়া সরকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার উত্তরার আজমপুর এলাকার আশরাফুল উলুম মাদরাসায় পড়ুয়া ছোট ভাই আব্দুল্লাহকে আনতে নরসিংদীর বাসা থেকে বের হন সজিব। আজমপুর এলাকায় যখন বাস থামে সে সময় আন্দোলনকারী আর পুলিশের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছিল। বিকেল তখন সাড়ে ৫টা থেকে ৬টার মধ্যেবর্তী সময়। বাস থেকে নেমে আজমপুর আশরাফুল উলুম মাদরাসার উদ্দেশ্যে রাস্তার পাশ ধরে হাঁটতে থাকে। এ সময় পুলিশের ছোড়া গুলিতে নিহত হন আমার বড় ভাই। পরে সন্ধ্যা ৭টায় ভাইয়ের বন্ধুর মাধ্যমে খবর পেয়ে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যাই। সেখানে গিয়ে জানতে পারি সজিবকে আজমপুরের রাস্তা থেকে কয়েকজন লোক গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসে। তিনি আরও বলেন, আমার ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমাদের এতো বড় সংসার কি করে চলবে?।

নিহতের ভাই আব্দুল্লাহ বলেন, এর আগের সপ্তাহে ভাই মাদরাসায় এসেছিল। ওই সময় উনার সাথে সর্বশেষ দেখা হয়। তিনি যাবার সময় বলে গিয়েছিলেন আগামী ১৮ তারিখ বৃহস্পতিবার মাদরাসা ছুটি হলে তোমাকে এসে নিয়ে যাবো। আমার ১৮ তারিখ এসেছিলেন ঠিকই কিন্তু আমার কাছে পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি‌। এর আগে লাশ হয়ে গেলেন তিনি।  

আমার ভাইয়ের উপার্জনের টাকা দিয়ে ভাই বোনের পড়াশোনাসহ অসুস্থ মায়ের খরচ চলতো। ভাই মারা গেছেন। এখন আমরা কীভাবে চলবো? 

সেই রাতেই উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে স্বজনরা ডা. সজীবের মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসে। পরদিন নিজ এলাকায় পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

নজরুল ইসলাম নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, সজিব ডাক্তারি পাশ করার পর সময় পেলেই এলাকায় এসে বিনামূল্যে মানুষের চিকিৎসা সেবা দিতেন। তার মৃত্যু সত্যিই মেনে নেওয়া যায় না।


নিহত সজীবের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বাবা মো. হালিম সরকার (৫৮) বিলাপ করে বলছেন, ‘ওরা কেন আমার ছেলেটাকে কেড়ে নিলো? আমার ছেলে তো কারও ক্ষতি করেনি। আমি এখন কার কাছে বিচার চাইবো? আমার সজীবকে তোমরা এনে দাও। ’

তিনি আরও বলেন, ছেলেকে খুব কষ্ট করে ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পঞ্চম থেকে এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করাই। পরে টঙ্গীর বেসরকারি তাইরুন্নেছা মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে ভর্তি করি। ২০২০ সালে থেকে এমবিবিএস পাশ করে চিকিৎসক হন সজিব। তাকে চিকিৎসক বানাতে গিয়ে ঋণে জর্জরিত আমরা। এখন কী হবে আমাদের।

ছেলে আমার খুব ধার্মিক ছিলেন। অনেক কষ্ট করে ছেলেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশোনা করিয়ে দেশের সেবক বানিয়েছি। অথচ আমাির ছেলেকে মেরে ফেলল। সঠিক তদন্ত সাপেক্ষে আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। তাহলেই তার আত্মা ও আমরা শান্তি পাবো।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৯ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০২৪
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।