ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

লালমনিরহাটে বন্যায় ডুবেছে রেল লাইন, পানিবন্দি ২৫ হাজার পরিবার

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৪
লালমনিরহাটে বন্যায় ডুবেছে রেল লাইন, পানিবন্দি ২৫ হাজার পরিবার

লালমনিরহাট: উজানের পাহাড়ি ঢল আর কয়েকদিনের টানা ভারী বৃষ্টিতে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বেড়ে বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও দুপুরে তা কমতে শুরু করে। সৃষ্ট বন্যায় তলিয়ে গেছে লালমনিরহাট সান্তাহার রেলরুটের অর্ধকিলোমিটার পথ।


রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) বিকেলে বন্যার পানিতে ডুবে থাকা রেল লাইন সংস্কার করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৩টায় হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানীতে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৭ মিটার। যা বিপৎসীমার (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ মিটার) ৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর আগে সকাল ৬টায় বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, শনিবার দুপুর থেকে তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হচ্ছে। রোববার সকাল ৬টায় বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পরে দুপুর নাগাদ কমে বিপৎসীমার নিচে নেমে আসে পানি প্রবাহ। বিকেল ৩টায় বিপৎসীমার ৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ডালিয়া পয়েন্টে। ফলে বামতীরের জেলা লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ২৫ হাজার পরিবার। প্রতিমুহূর্তে বাড়ছে এর সংখ্যা। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে তিস্তাপাড়ের মানুষ।

পানির চাপ বেড়ে যাওয়ায় লালমনিরহাট সান্তাহার রেলরুটের লালমনিরহাট সদর উপজেলার গোকুন্ডা ইউনিয়নের রতিপুর এলাকায় অর্ধকিলোমিটার রেলপথ ডুবে যায়। এ সময় পানির স্রোতে ভেসে যায় রেল লাইনের পাথর। ফলে দিনভর ঝুঁকি নিয়ে ধীর গতিতে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রেখেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করা হয় রেল লাইন। আপাতত রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক রয়েছে।

টানা দুই দিনের বন্যায় নদী তীরবর্তী এলাকার বেশ কিছু রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট ভেঙে গেছে পানির তোরে। উঠতি আমন ধান ও বিভিন্ন সবজি ক্ষেত ডুবে আছে বন্যার পানিতে। দীর্ঘ সময় ডুবে থাকলে এসব ফসলের মারাত্মক ক্ষতির শঙ্কা করছেন চাষিরা। একইসঙ্গে বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গেছে বেশ কিছু পুকুরে মাছ। মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে সলেডি স্প্যার বাঁধসহ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো। শনিবার রাতভর সলেডি স্প্যার বাঁধ ২ এর ওপর দিয়ে অভার ফ্লো প্রবাহিত হয়। বাঁধ ভেসে যাওয়ায় শঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ভাটিতে থাকা শত শত পরিবার। স্থানীয়রা রাতে বালু ভর্তি বস্তা ফেলে বাঁধের ভাঙন থেকে রক্ষা করে।

বন্যার পানিতে বিদ্যালয় ডুবে থাকায় জেলার ১৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বপন কুমার।  

গবাদি পশু পাখি নিয়েও নিদারুণ কষ্টে পড়েছেন খামারি ও সাধারণ কৃষকরা। ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করায় রাস্তা বা বাঁধের উঁচু স্থানে পলিথিন সাঁটিয়ে রাখা হয়েছে এসব গৃহপালিত পশু পাখি। অনেক পরিবার বাড়ি থেকে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। বড় বিপাকে পড়েছেন শিশু বৃদ্ধ আর প্রতিবন্ধীরা।

টয়লেট ডুবে যাওয়ায় প্রস্রাব-পায়খানা করতে বড় বিপাকে পড়েছেন বন্যাকবলিত এলাকার নারীরা। বন্যাকবলিতদের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে ত্রাণ বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা এখন পর্যন্ত বন্যা কবলিতদের মাঝে বিতরণ শুরু হয়নি। খুব দ্রুত ত্রাণ বিতরণ শুরু হবে বলেও জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে।

সলেডি স্প্যার বাঁধ -২ এলাকার এমদাদুল হক বলেন, রাতে পানির গর্জনে ঘুমাতে পারিনি। সলেডি স্প্যার বাঁধে ব্রিজ অংশের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। এ সময় বাঁধ কাঁপছিল। আমরা ভয় পেয়েছিলাম যে, স্প্যার বাঁধ বুঝি ভেসে যায়। স্থানীয়রা রাত জেগে বাঁধে বস্তা ফেলে রক্ষা করেছে। বন্যার সময় নির্ঘুম রাত কাটে তিস্তাপাড়ের মানুষদের।

গোবর্দ্ধন গ্রামের কৃষক মজিদুল ইসলাম বলেন, দুই রাত থেকে তিস্তা নদীতে পানি বাড়ছে। আমাদের গ্রাম পানিতে ডুবে আছে। নৌকা দিয়ে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ির যোগাযোগ করতে হচ্ছে। ডুবে থাকা আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। এ নিয়ে চিন্তায় বেশি সময় এমন থাকলে ধান গাছ পচে নষ্ট হতে পারে।

হাতীবান্ধা উপজেলার পশ্চিম বিছনদই গ্রামের তমিজ উদ্দিন বলেন, আমাদের গ্রামে আড়াই/তিনশ পরিবার শুক্রবার থেকে পানিবন্দি। দিন যত যাচ্ছে পানিবন্দির সংখ্যা তত বাড়ছে। রোববার বিকেল নদীতে পানি কমলেও বন্যার পানি খুবই ধীরগতিতে নামছে। ফলে এখনও পানিবন্দি রয়েছি আমরা। বন্যার সময় শিশু বৃদ্ধ আর গবাদি পশুপাখি নিয়ে বড় বিপদে পড়তে হয়। বন্যা হলেই নির্ঘুম রাত কাটাতে হয় তিস্তাপাড়ের মানুষদের। আমরা ত্রাণ নয়, চাই তিস্তার মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন।

ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান বলেন, আমার ইউনিয়নে তিন/সাড়ে তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিষয়টি উপজেলা ও জেলা প্রশাসনকে অবগত করা হয়েছে। শুকনো খাবার এখন পর্যন্ত বরাদ্দ আসেনি। বরাদ্দ এলে পৌঁছে দেওয়া হবে।

মহিষখোচা ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ হোসেন বলেন, আমাদের ইউনিয়নের ৩ হাজারের অধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাঁধগুলো রক্ষায় সাধারণ মানুষদের নিয়ে বস্তা ফেলে রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুনিল কুমার বলেন, রোববার সকাল ৬টায় তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ বেড়ে বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর প্রবাহিত হয়। দুপুরে তা কমে গিয়ে বিপৎসীমার নিচে নেমে আসে। আশা করছি দ্রুতই বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, বন্যা কবলিতদের জন্য ১৩ লাখ টাকা ও ৯০ মেট্রিক টন জিআর চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আজকে স্বল্প পরিসরে বিতরণ শুরু করেছি। সোমবার সবার কাছে পৌঁছে যাবে ত্রাণ। বন্যার বাড়লে তা মোকাবেলা করতে জেলা উপজেলা প্রশাসন আমরা প্রস্তুত রয়েছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৮১২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৪
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।