ঢাকা: রাজধানীতে সিটি সার্ভিসের বাস পরিষেবা উন্নত করে বাস রুট রেশনালাইজেশন পদ্ধতিতে বাসের জন্য প্রাধিকার লেনের ব্যবস্থা করলে যানজট নিরসন সম্ভব। এমনটি মনে করে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
পাশাপাশি নগরের প্রধান প্রধান সড়ক থেকে রিকশা, ইজিবাইকসহ ছোট ছোট যানবাহন তুলে দিয়ে বৈজ্ঞানিক পন্থায় ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ এবং মোটরসাইকেল নিবন্ধন বন্ধ করা গেলে যানজট সমস্যা দ্রুত সমাধান করা সম্ভব বলেও মনে করে সংগঠনটি।
রোববার (০৬ অক্টোবর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) ‘গণপরিবহন সংকট ঢাকার ভয়াবহ যানজটের মূল উৎস-মুক্তি চাই নগরবাসী’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এসব সুপারিশ তুলে ধরেন।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা এবং পরিবহন সংশ্লিষ্টরা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করায় ভয়াবহ যানজটে নাকাল রাজধানীবাসী। নগরের এক প্রান্ত থেকে যেকোনো গন্তব্যে যেতে চার-পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। ঢাকার যানজটে প্রতিদিন কর্মক্ষম মানুষের ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। বুয়েটের তথ্য বলছে, প্রতিবছর এ যানজটে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা।
পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে সংগঠনের মহাসচিব বলেন, রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থা বহুযুগ আগেই ভেঙে পড়েছে। নগরে চলাচলকারী বাস-মিনিবাস রংচটা, বিবর্ণ, লক্কড়ঝক্কড়, পেছনের লাইট-ইন্ডিকেটর আর সামনের লুকিং গ্লাস নেই। আসনে দুই পা মেলে বসা যায় না। বাসে ওঠা-নামার পাদানি, ধরার হেন্ডেল ভাঙা থাকে। দীর্ঘসময় ধরে দাঁড়িয়ে গাদাগাদি করে যেতে হয়।
তিনি বলেন, গরমের দিনে ঘামে ভিজে এবং বর্ষাকালে বাসের ভেতর বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু অবস্থা হয়। কোনো বাসে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বালাই নেই। ময়লা-আবর্জনা, ছারপোকা, তেলাপোকায় ভরপুর, মুড়ির টিনের মতো বাসে ওঠানামার ভয়াবহ যন্ত্রণা সহ্য করেও সঠিক সময়ে বাস পাওয়া যায় না। অফিস সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না।
নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, অসুস্থদের জন্য এসব বাসে ওঠানামা এবং ভেতরে গাদাগাদি করে যাতায়াত করা চরম ভোগান্তির- এমনটি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, এর সঙ্গে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য, চালক-শ্রমিকদের দুর্ব্যবহার তো রয়েছেই। এমন বাস্তবতায় সামর্থ্যবানেরা ধার-দেনা করে ব্যক্তিগত গাড়ি কিনছেন। অন্যরা মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিং, অটোরিকশা, ইজিবাইক পাঠাও-উবারের মতো ছোট ছোট যানবাহনে স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াতের দিকে ঝুঁকছেন।
মহাসচিব বলেন, নগরে বিশৃঙ্খল বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চার লাখ প্যাডেলচালিত রিকশা, ছয় লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক, এক লাখ ৩৪ হাজার রাইড শেয়ারিংয়ের ছোট ছোট যানবাহন, ৩০ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা অবাধ যাতায়াতের কারণে নগরের যানজট ও জনজট চরমভাবে বেড়ে চলেছে। অন্যদিকে এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক ব্যবস্থা এখনো সেকেলে পদ্ধতিতে রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর নগরের চার হাজার ট্রাফিক পুলিশ এখনো নিষ্ক্রিয়।
তিনি বলেন, যানজট কমাতে জরুরি ভিত্তিতে অত্যাধুনিক প্রকৌশলগত ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা দরকার। এর পাশাপাশি দরকার প্রকৌশলগত গবেষণা করে দুই বা তিন লেনের ছোট ইন্টারসেকশনে ট্রাফিক সিগনাল এক থেকে দুই মিনিট আর বড় ইন্টারসেকশনে ট্রাফিক সিগনাল দুই থেকে তিন মিনিট চালু রাখা। যানজট হয় না এমন স্পটগুলোতে বাস স্টপেজ তৈরি করা, যত্রতত্র বাস দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলা বন্ধ করে নির্দিষ্ট বাস স্টপেজ থেকে যাত্রী তোলা বাধ্যতামূলক করা জরুরি।
বিআরটিএর তথ্য দিয়ে তিনি জানান, রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে ছোট ছোট ৮০০ গাড়ি নামছে। জাইকার সমীক্ষা অনুযায়ী ঢাকা মহানগরে প্রতিদিন গড়ে চার কোটি ট্রিপ হয় এর মধ্যে ৬০ শতাংশ যাত্রী গণপরিবহন ব্যবহার করেন। এ যাত্রীদের ৬৭ শতাংশ কেবল বাস ব্যবহার করেন। অথচ ঢাকা সিটি বাসের মান-গুণ গত ২০ বছর ধরে ঠিক নেই।
তিনি আরও জানান, ঢাকার যানজট কমাতে হলে সর্বপ্রথম বাস-মিনিবাস ব্যবস্থা ঠিক করতে হবে। বাস রুট রেশনালাইজেশনের মাধ্যমে বাসের জন্য প্রাধিকার লেনের ব্যবস্থা করতে হবে। ছোট ছোট যানবাহনের নিবন্ধন এবং নগরের প্রধান সড়কে এসব যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে।
ঢাকার যানজট সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে, উন্নত সিটিবাসের ব্যবস্থা করা, বাস রুট রেশনালাইজেশনের মাধ্যমে বাসের জন্য প্রাধিকার লেনের ব্যবস্থা করা, জরুরি ভিত্তিতে ঢাকায় মোটরসাইকেলসহ ছোট ছোট যানবাহন নিবন্ধন বন্ধ করা।
আরও রয়েছে রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক করিডোর থেকে প্যাডেলচালিত রিকশা, ইজিবাইকসহ ধীরগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করা, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, ফুটপাতে স্বাচ্ছন্দ্যে পথচারী যাতায়াতের ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনে সড়কে উড়াল ফুটপাত তৈরি করা।
যানজট নিয়ন্ত্রণে পরামর্শের মধ্যে আরও রয়েছে, ট্রাফিক সিগন্যাল ডিজিটাল করা, ট্রাফিক প্রসিকিউশন সিস্টেমে উন্নত বিশ্বের মতো ক্যামেরা পদ্ধতি চালু করা, জরিমানার অর্থ পরিবহন মালিক-চালকের ব্যাংক হিসাব থেকে আদায়ের ব্যবস্থা করার পরামর্শও তুলে ধরেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
প্রধান সড়ক, সড়কের বাঁকে পার্কিং-লোডিং-আনলোডিং বন্ধ করা, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা বন্ধ করা, যত্রতত্র হাত তুলে রাস্তা পারাপার বন্ধ করে জেব্রাক্রসিং, ফুটওভার ব্রিজ, আন্ডারপাস ব্যবহার বাধ্যতামূলক করারও সুপারিশ করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
সুপারিশের মধ্যে আরও রয়েছে, যানজট সমস্যা চিহ্নিত করা ও তাৎক্ষণিক সমাধানের জন্য ডিটিসিএ, ডিএনসিসি, ট্রাফিক বিভাগের সমন্বয়ে চার-ছয় সদস্যের একটি ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিশেষজ্ঞ টিম তৈরি করা, সার্বক্ষণিক যানজট পরিস্থিতি মনিটরিং করবে এবং তাৎক্ষণিক সমাধান দেবে, এমন একটি অভিজ্ঞ-বিশেষজ্ঞ টিম তৈরি করা। ঢাকার প্রবেশদ্বারগুলো যানজটমুক্ত রাখার উপায় বের করা এবং বিকল্প সড়কগুলো ব্যবহারে ট্রাফিক নির্দেশনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করারও সুপারিশ করেছে সংগঠনটি।
মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার যানজটমুক্ত করতে গুলিস্তান পার্ককে অস্থায়ী টার্মিনাল বানানো, কারিগরি দিক বিবেচনা করে রাজধানীতে প্রবেশমুখী র্যাম্প বাড়ানো, বাস দাঁড়ালে যানজট হয় না- সমীক্ষা চালিয়ে এমন স্পটগুলো খুঁজে নগরজুড়ে ৩০০ বাসস্টপেজের ব্যবস্থা করা এবং এসব বাসস্টপেজে যাত্রী ওঠা-নামা বাধ্যতামূলক করা, ইতোমধ্যে তৈরি করা বাস-বে জরুরি ভিত্তিতে যাত্রী ওঠা-নামায় ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
সংবাদ সম্মেলনে যানজট বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী কামরুল হাসান, এবি পার্টির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, নাগরিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান শরীফ, যাত্রী কল্যাণ সমিতির সহ-সভাপতি তাওহীদুল হক লিটন, যুগ্ম মহাসচিব এম. মনিরুল হক, প্রচার সম্পাদক মাহামুদুল হাসান রাসেলসহ আরও অনেকে বক্তব্য দেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৬, ২০২৪
এমআইএইচ/আরএইচ