চাঁদপুর: গত ১৮ জুলাই বেলা ১১টার দিকে বাসায় ফেরার পথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে আহত হন মো. হাসান সিকদার। চোখে ও মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে গত ১৯ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
জানা যায়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ হাসান চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার কড়ইয়া ইউনিয়নের তুলাতলি গ্রামের সিকদার বাড়ির কবির হোসেনের ছেলে। তিনি দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়তেন। স্বপ্ন দেখতেন, বড় হয়ে দারিদ্য ঘোচাবেন। সেই স্বপ্ন পূরণে পড়ালেখা ও সংসারের খরচ জোগাতে রাজধানীর ভাটারা এলাকায় একটি লাইব্রেরিতে কাজ নেন তিনি। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের আগেই পুলিশের গুলিতে চিরবিদায় নিতে হয় এ যুবককে।
সম্প্রতি হাসানদের বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, হাসানের বাবা কবির হোসেন একজন শ্রমিক। তবে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে এখন কর্মক্ষম। হাসানের মা হালিমা বেগম গৃহিণী। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট এক বোন কচুয়া বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে এবং ছোট বোন স্থানীয় একটি মাদরাসায় সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। পরিবারের কোনো উপার্জন করা ব্যাক্তি না থাকায় বাধ্য হয়ে হাসান কাজে যোগ দেন। শিক্ষিত হয়ে সংসারের হাল ধরবেন এবং বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবেন হাসান। কিন্তু তার স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। গত ১৮ জুলাই শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে তার মৃত্যু হয়।
হাসানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মো. তারেক বলেন, আমি ও হাসান মনোহরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মনোহরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়েছি। এসএসসি উত্তীর্ণ হওয়ার পর আমি কচুয়া বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি সরকারি কলেজ এবং হাসান রহিমানগর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হয়। একাদশ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর হাসানদের সংসারে অভাব প্রকোট হয়ে উঠে। কারণ তার বাবা এলাকায় কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্থানীয় লোকদের সহযোগিতায় তার বাবার চিকিৎসা খরচের যোগান হয়। এ বছর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আগে আমি এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। কাজের সন্ধানে ঢাকায় চলে যায় হাসান। তাকে পরীক্ষা দেওয়ার অনুরোধ করলেও সংসারের নানা অভাবের কথা বলে খুবই দুঃখ প্রকাশ করে হাসান। তাকে আমি পরীক্ষার খরচের ব্যবস্থা করে দেব বলে অনুরোধ জানাই। কিন্তু সে রাজি হয়নি।
হাসানের সম্পর্কে চাচা মোশারফ সিকদার বলেন, এই পরিবারটি খুবই নিরীহ এবং দরিদ্র। তবে হাসান ছোট বেলা থেকে মেধাবী হওয়ায় তার প্রতি আমাদের আদর-স্নেহ ছিল। তার পড়ালেখা যেন বন্ধ না হয়ে যায় সে কারণে সবার সহযোগিতায় তার পড়ার খরচের ব্যবস্থা হয়। এরই মধ্যে তার বাবা কবির হোসেন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়। হাসানদের বসতঘর ছিল খুবই ছোট। লোকজনের সহযোগিতায় একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। তার বড় বোনকেও সবাই মিলে সহযোগিতার মাধ্যমে বিয়ে দিতে হয়।
তিনি আরও বলেন, হাসানের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লে পরিবারের খরচ চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। কবির হোসেন প্রায় সময় তার নানা সমস্যার কথা আমাদের কাছে বলতেন। ছেলেকে নিয়ে খুবই চিন্তা করতেন। ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। কিন্তু সর্বশেষ এভাবে হাসানের মৃত্যু হবে কেউ ভাবতে পারিনি। তার মরদেহ বাড়িতে এনে দাফন করার খরচও আমাদের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। দরিদ্র এই শহীদ পরিবারের জন্য সবার এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
হাসানের ছোট বোন লিমা বলেন, ভাইয়ার সঙ্গে আমার সবচাইতে বেশি কথা হত। ঢাকায় যাওয়ার পর বেশিরভাগ সময় ইমোতে ফোন দিত। সর্বশেষ ১৭ তারিখে আমার সঙ্গে কথা হয়। ওই দিন বিকেলে ফোন দেয়। রাতে মায়ের সঙ্গেও কথা হয়। পরের দিন ১৮ জুলাই সকালে আমি মোবাইলে ম্যাসেজ দেই। কিন্তু কোনো উত্তর আসে না। ওইদিনই বেলা ১১টার দিকে ভাই লাইব্রেরি থেকে বের হলে গুলিবিদ্ধ হয়। দুপুরে আড়াইটার দিকে আমরা খবর পাই। এরপর মা-বাবা সবাই ঢাকায় চলে যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজে গিয়ে ভাইকে আহত অবস্থায় দেখতে পায়।
হাসানের মা হালিমা বেগম ছেলের মৃত্যুর নির্মম অবস্থার কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে তার চোখে মুখে অনিশ্চয়তার চাপ। তিনি বলেন, ছেলে আমার মেধাবী ছিল। সংসারের হাল ধরার জন্য এ বছর পরীক্ষা না দিয়ে লাইব্রেরিতে কাজ নেন। ঢাকায় থাকলেও আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ১৭ জুলাই জুলাই গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আমরা প্রতিবেশী একজনের মাধ্যমে খবর পাই। তিনি জানান ঢাকা মেডিকেলে আসে হাসান। এরপর ঢাকায় রওয়ানা হই। আন্দোলনের কারণে কাঁচপুর ব্রিজের পরে আর যেতে পারিনি। তার বাবাসহ পায়ে হেঁটে হাসপাতালে যেতে হয়। হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার ছেলে আইসিইউতে। চিকিৎসকরা বলছিলেন ৭২ ঘণ্টা দেখবে। প্রথমে তার মাথায় অপারেশন এবং পরে চোখে অপারেশন করবে। কিন্তু তার আগেই ১৮ জুলাই রাত পৌনে ১০টার দিকে ছেলের মৃত্যু হয়। পরে বাড়িতে এনে তার দাফন করা হয়।
তিনি আরও বলেন, আমার ছেলে তার অনেক স্বপ্নের কথা আমাদের বলেছে। প্রায় সময় বলত মা আমি বিদেশে যাব। তখন টাকা রোজগার হলে তোমাদের আর কষ্ট থাকবে না। বোনদের বিয়ে দিতে পারবো। বড় বোনকে সহযোগিতা করব। বাবার চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে। আমাদের ঘর তৈরি হবে। সেসব স্বপ্ন, স্বপ্নই রয়ে গেল।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমার ছেলের দাফনের পরে বাড়িতে মিলাদ হয়েছে। সেখানে গরীব লোকদের খাওয়ানো হয়। কিন্তু আমি এক অভাগা মা ছেলের এই আয়োজনে এক কেজি চালও দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না আমার।
চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন বলেন, ছাত্রজনতার আন্দোলনে প্রত্যেক শহীদ পরিবারের জন্য সরকারি যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেসব নির্দেশনা আমরা বাস্তবায়ন করছি। আমি নিজে এবং উপজেলা পর্যায়ে ইউএনওরা খোঁজখবর নিচ্ছেন এবং সহায়তা করছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪১ ঘণ্টা, অক্টোবর ৯, ২০২৪
এসএম