ঢাকা: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের। জনরোষের মুখে সেদিন পালিয়ে ভারতে চলে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
দিল্লির ‘আস্থাভাজন’ শেখ হাসিনার সরকারের এমন বিদায়ের পর দুদেশের সম্পর্কে যে নাটকীয় অবনতি ঘটেছিল, দেড়শ দিন পরে এসে তা কোন পর্যায়ে আছে, সাউথ ব্লকেরই মনোভাব কী, তা নিয়ে আগ্রহ আছে এদেশের রাজনীতি সচেতন মহলে।
এ বিষয়ে একটি খবর প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা। এতে বলা হয়েছে, গত কয়েক মাসে দুই দেশের সরকারের পরস্পরের প্রতি ব্যবহার যে ‘বন্ধুপ্রতিম’ হয়নি, সেটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। তা সত্ত্বেও খুব সম্প্রতি এমন কিছু কিছু লক্ষণ দু-পক্ষ থেকেই দেখা যাচ্ছে, যা বিবেচনায় নিয়ে দিল্লিতে কোনো কোনো পর্যবেক্ষক ধারণা করছেন—নতুন বছরে হয়তো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে একটা উন্নতির সম্ভাবনা আছে।
বিবিসি বাংলার খবর অনুসারে, এর কারণটা খুব সহজ, তাগিদ আছে দু-পক্ষেরই।
পর্যবেক্ষকদের ধারণা, বাংলাদেশ-ভারতকে যে পরস্পরের স্বার্থেই নিজেদের মধ্যে কূটনৈতিক, স্ট্র্যাটেজিক বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ‘মোটামুটি একটা সুসম্পর্ক’ রেখে চলতে হবে, এই উপলব্ধিটা ধীরে ধীরে আবার ফিরে আসছে এবং তার রাস্তাটা খুঁজে বের করারও চেষ্টা চলছে।
তবে পর্যবেক্ষকরা এটাও স্পষ্ট করে দিচ্ছেন, ভারতের দিক থেকে এই প্রচেষ্টা হবে পুরোপুরি ‘শর্তমূলক’। অর্থাৎ ভারতের দেওয়া বিশেষ কয়েকটি শর্ত পূরণ না হলে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দিল্লি সম্ভবত খুব একটা ‘গরজ’ দেখাবে না।
সেক্ষেত্রে কোনো শর্ত ‘জনমতবিরুদ্ধ’ হলে ঢাকা তা বিবেচনায় নেবে কি না, বা নিতে পারবে কি না, সেটাও বড় প্রশ্ন।
দিল্লির শর্তের মধ্যে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা কিংবা পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অন্তর্ভুক্ত করার মতো অতি স্পর্শকাতর বিষয়ও থাকতে পারে। সামরিক বা নিরাপত্তাগত স্বার্থের দিকটিও অবশ্যই গুরুত্ব পাবে।
যদিও বিচার হওয়ার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করতে দেওয়ার বিষয়ে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধীদের তীব্র বিরোধিতা আছে। তারা মনে করে, দেড় সহস্রাধিক মানুষ হত্যার জন্য তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচারের আগে দলটিকে ভোটে আসতে দেওয়া হবে শহীদদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও নতুন বছরে স্পষ্ট করে দিয়েছে, তারা ‘ঠিক কোন ধরনের’ বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ায় আগ্রহী। মানে সম্পর্ক চুকিয়ে দেওয়াটা যে কোনো ‘অপশন’ নয় – প্রকারান্তরে দিল্লিও সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে।
পাশাপাশি গত কয়েকদিনে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর প্রধান কিংবা অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের বক্তব্যে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে যে ধরনের বার্তা এসেছে, সেটাকেও ভারত বেশ ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
দিল্লিতে শীর্ষস্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যে ভারত-বিরোধী ‘রেটোরিক’ থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে এটা একটা ভালো লক্ষণ, যা সুস্থ ও স্বাভাবিক সম্পর্কের পথ প্রশস্ত করতে পারে।
আর অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে দু-দেশের সহযোগিতা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে–সেটা খানিকটা ‘অটো পাইলট’ মোডে বা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চলতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যাতে দু-পক্ষের সরকারি হস্তক্ষেপের হয়তো তেমন প্রয়োজন হবে না।
ভারত ঠিক কী ধরনের বাংলাদেশ দেখতে চায়, এর জবাবে শেখ হাসিনার আমলে সাউথ ব্লক (ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এলাকা) বারবার যে কথাটা বলতো–তারা একটি ‘শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল’ বাংলাদেশের পক্ষে।
এই কথাটাকে অবশ্য ‘আস্থাভাজন’ শেখ হাসিনার প্রতি ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থন হিসেবেই দেখা হতো। তার শাসনামলে সমৃদ্ধি তথা উন্নয়ন ও অগ্রগতির গল্পই বেশি শুনতেন দেশের জনগণ।
গত ৩ জানুয়ারি দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সাপ্তাহিক ব্রিফিং-এ বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে মুখপাত্র নতুন দুটি শব্দ যোগ করেন।
মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল একটি প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সাম্প্রতিক ঢাকা সফরের পরই প্রেস বিবৃতির আকারে এই মনোভাব স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, ভারত একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল, ইনক্লুসিভ বাংলাদেশকে সমর্থন করে। ’
‘এটাও বলা হয়েছে যে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক গড়তে চাই, যা হতে হবে পারস্পরিক আস্থা, মর্যাদা, স্বার্থ ও একে অপরের উদ্বেগগুলো নিয়ে সংবেদনশীলতার ভিত্তিতে। ’
বছরখানেক আগেকার চেয়ে ভারত সরকারের মুখপাত্রের এই বক্তব্যে নতুন শব্দ দুটি হচ্ছে – গণতান্ত্রিক আর ইনক্লুসিভ (অন্তর্ভুক্তিমূলক)।
দিল্লির বিশ্লেষকদের মন্তব্য, প্রথম শব্দের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশে দ্রুত ‘গণতান্ত্রিক ধারা’ ফেরার প্রত্যাশার কথা বলেছে। আর ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ শব্দের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করা এবং রাজনীতিতে ‘সব ধরনের শক্তিকে’ অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার অভিমত প্রকাশ করেছে।
৫ আগস্টের পর এই প্রথম (৩ জানুয়ারি) ভারত প্রকাশ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ‘ইতিবাচক ও গঠনমূলক’ সম্পর্ক গড়ে তোলার আগ্রহ ব্যক্ত করেছে।
হাসিনার সরকারের পতনের পর বেশ কয়েক মাস ধরে ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’র অভিযোগ, ত্রিপুরা থেকে কোনো সতর্কতা না দিয়ে পানি ছেড়ে ফেনী-নোয়াখালী অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা ঘটানোর অভিযোগ, ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী সংঘবদ্ধ প্রোপাগান্ডা, এর জেরে ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকদের বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য ও আগরতলায় বাংলাদেশ দূতাবাসে হামলা ইত্যাদি ইস্যুতে উত্তেজনা ছড়িয়েছে দুপক্ষের সম্পর্কে। পাঁচ মাসের মাথায় দিল্লির দিক থেকে ‘ইতিবাচক ও গঠনমূলক’ সম্পর্কের আগ্রহ প্রকাশ অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ।
ঢাকায় ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত ভিনা সিক্রি মনে করেন, ভারত যে বাংলাদেশের সঙ্গে সহজ ও স্বাভাবিক সম্পর্ক চায় এর মধ্যে কোনো ভুল নেই। তবে এখন কয়েকটি বিষয় নিয়ে দিল্লিকে সাবধান থাকতে হবে। বাংলাদেশ কিন্তু বরাবরই আমাদের জন্য একটি প্রায়োরিটি কান্ট্রি (অগ্রাধিকার রাষ্ট্র) ছিল, এখনো তাই আছে – কিন্তু এই সম্পর্ককে আমরা তখনই অগ্রাধিকার দেব যখন এটা উভয়ের জন্যই সুফল বয়ে আনবে।
গত মাসে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির ঢাকা সফরের মধ্যে দিয়ে দিল্লি ঠিক এই বার্তাই দিয়েছে বলে তিনি মনে করছেন।
তবে এখানে কয়েকটি ‘যদি’ বা ‘কিন্তু’ আছে উল্লেখ করে ভিনা সিক্রি বলেন, পাকিস্তান যেভাবে এই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চাইছে সেটা ভারতের জন্য সত্যিকারের নিরাপত্তাগত হুমকি। বাংলাদেশের মাটিকে পাকিস্তান যে কোনোভাবে ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থের বিরুদ্ধে বা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে ব্যবহার করবে না, সেটা নিয়ে শতকরা একশোভাগ নিশ্চিত হতে পারলে তবেই ভারত এই সম্পর্ক নিয়ে এগোতে পারবে।
এই কূটনীতিকের ভাষ্যে, যত দ্রুত সম্ভব সে দেশে নির্বাচন আয়োজনের ওপর ভারত জোর দেবে। শুধু তাই নয়, সে নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হতে হবে, এবং তাতে সব দল ও মতাবলম্বীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের গবেষক অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্তের ভাষ্য, এই সম্পর্কের চট করে নাটকীয় উন্নতি হবে বলে তিনি তেমন আশাবাদী নন।
অবশ্য বাংলাদেশের সোনপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বা পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে সম্প্রতি যা বলেছেন, তার ভূয়সী প্রশংসা করছেন শ্রীরাধা।
তিনি বলেন, মুশকিলটা অন্য জায়গায়। ভারত অবশ্যই সে দেশে দ্রুত নির্বাচনের জন্য জোর দেবে এবং চাইবে আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনে লড়ার সুযোগ পাক। বাংলাদেশ যদি নির্বাচনের আগে (ভারতের পছন্দ অনুযায়ী) সেই আওয়ামী লীগ ইস্যুটার নিষ্পত্তি করতে না পারে, তাহলে ভারত হয়তো আবার বেঁকে বসবে এবং অসহযোগিতার রাস্তায় হাঁটবে।
এর পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিচারের জন্য ফেরত দেওয়ার প্রশ্নেও ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে অস্বস্তি থাকবে উল্লেখ করে শ্রীরাধা বলেন, ভারত শেখ হাসিনাকে কিছুতেই প্রত্যর্পণ করবে না, ফলে আমার ধারণা, সম্পর্ক আবার সেই শীতলতার দিকেই যাবে।
রাজনৈতিক, কূটনৈতিক বা স্ট্র্যাটেজিক বিষয়ে ঢাকা-দিল্লির দূরত্ব গত কয়েকমাসে অনেকখানি স্পষ্ট হলেও অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এই প্রভাব মারাত্মক আকারে দেখা যায়নি। চাল, পেঁয়াজসহ অনেক ভারতীয় পণ্য নিয়মিত আসছে বাংলাদেশে। আবার দুর্গাপূজার সময় বাংলাদেশ থেকেও ইলিশ গেছে ভারতে।
বিশ্লেষকদের ভাষ্যে, বাংলাদেশে প্রায় ২০ কোটি মানুষের একটা বাজার ভারত যেমন কখনো ছাড়তে চাইবে না বা ছাড়া উচিত হবে না, তেমনি বহু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বা ভারী সরঞ্জাম আমদানির জন্য বাংলাদেশও ভারতের চেয়ে ভালো উৎস আর পাবে না। এই অর্থনৈতিক বাস্তবতাই দুটো দেশকে শেষ পর্যন্ত কাছাকাছি রাখবে। সেটা এরই মধ্যে কলকাতাসহ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর ব্যবসায়ীদের বক্তব্যেই উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০২৫
এইচএ/