স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে উত্তাল সময় পার করছি আমরা। জুলাইয়ের অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে এক অস্থির ও সম্ভাবনার সময় উপস্থিত হলেও এই অবস্থায় এসে উপনীত হওয়ার পেছনে আছে বাংলাদেশের ৫৩ বছরের রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থার ধারাবাহিকতা।
বাংলাদেশের রাজনীতি ৫৩ বছর ধরেই এক ধরনের দোলাচলের মধ্যে কাটিয়েছে। সংকট ও সম্ভাবনার, আশা ও আশাভঙ্গের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ জীবন যাপন করেছে। এই সময়ে শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটেছে বহুবার। ১৯৭২ সালে সংসদীয় ব্যবস্থা দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও সেই ব্যবস্থার অবসান ঘটে সাড়ে তিন বছরের মাথায়—বাংলাদেশ একটি একদলীয় রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থায় প্রবেশ করে। তার অবসান ঘটে সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে।
সেনাশাসনের দীর্ঘ দেড় দশকের ইতিহাস শেষে এক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সংসদীয় ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন ঘটে ১৯৯১ সালে।
কিন্তু যে সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়ে নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পুনর্যাত্রা, তা ক্রমান্বয়ে ফিকে হয়ে যায়। এই সময় একদিকে রাজনীতিতে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বদলে এক ধরনের ‘প্রধানমন্ত্রীর শাসনব্যবস্থার’ সূচনা হয়। ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের এই ব্যবস্থা, যার বীজ ১৯৭২ সালের সংবিধানের ভেতরেই নিহিত ছিল, তা বিভিন্ন সংশোধনীর মধ্য দিয়ে আরো বেশি প্রকাশ্য হয়ে পড়ে।
১৯৯১-২০০৬ পর্বে ক্ষমতার এই কেন্দ্রীকরণ সত্ত্বেও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা, গণমাধ্যম ও বিচার বিভাগের তুলনামূলক স্বাধীনতা এবং নাগরিকদের মধ্যে বিদ্যমান আশাবাদ একটি দুর্বল কিন্তু কার্যকর শাসনপ্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছিল। এই ব্যবস্থা একদিকে নাগরিকের ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছিল, অন্যদিকে ক্রমাগতভাবে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো বেশি ভঙ্গুর করে ফেলেছিল। কিন্তু ২০০৬ সালের শেষ নাগাদ রাজনৈতিক দলগুলোর কলহ, সহিংসতা এবং ক্ষমতায় টিকে থাকা ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের আগ্রহ এমন এক পর্যায়ে এসে উপনীত হয় যে এই প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতার সম্ভাবনাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
যে সীমিত গণতন্ত্র ছিল এই সময়ের বৈশিষ্ট্য, তার অবসান ঘটে এবং বাংলাদেশের রাজনীতির দৃশ্যপটে সেনাবাহিনীর আবির্ভাব ঘটে। সামরিক বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট বেসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই আশাবাদ তৈরি করে যে শাসনব্যবস্থার যে কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিকে এক ধরনের বৃত্তচক্রের মধ্যে নিয়ে গেছে, তারা সে বিষয়ে মনোনিবেশ করবে এবং ওই কাঠামোগুলো তারা ‘সংস্কার’ করবে।
শাসনব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের যে প্রত্যাশাগুলো দীর্ঘদিন ধরে লালিত ছিল, তার এক ধরনের প্রকাশ ঘটে সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের প্রতিশ্রুতিতে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা, শাসকদের চরিত্র, ক্ষমতা প্রয়োগে তাঁদের সীমা নির্ধারণে ব্যর্থতা এবং এক ধরনের বিরাজনীতিকরণের চেষ্টার ফলে সরকারের সংস্কারের বিষয়টি জনগণের কাছে ফাঁকা বুলিতে পরিণত হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শেখ হাসিনার সামনে ছিল দুটি বিকল্প। প্রথমত, ১৯৯১ থেকে ২০০৬—এই ১৫ বছরে শাসনের কাঠামোগত যে দুর্বলতা এবং ২০০৭-০৮ সালের সেনা সমর্থিত শাসনের অভিজ্ঞতার আলোকে রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কার, গণতান্ত্রিক প্রতিঠানগুলো তৈরি ও শক্তিশালী করা এবং জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট হওয়া। দ্বিতীয় বিকল্প ছিল ২০০৬ সালের আগের ধারায় ফিরে যাওয়া, অর্থাৎ এক ধরনের ভঙ্গুর রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক কাঠামো অব্যাহত রাখা, যেখানে রাজনৈতিক কলহ অব্যাহত থাকবে, কিন্তু প্রতি পাঁচ বছরে ক্ষমতার হাতবদলের সম্ভাবনা বিরাজ করবে, ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ কিছু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। শেখ হাসিনা এর কোনোটাই বেছে না নিয়ে শুধু বিরোধী দল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনই বেছে নিলেন না, বরং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে দিয়ে ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণের দিকেই অগ্রসর হলেন। এই পদক্ষেপের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে পঞ্চদশ সংশোধনী। এই বিচারে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পশ্চাদযাত্রার প্রথম মাইলফলক হচ্ছে ২০১১ সাল। এরপর আইন ও আইনবহির্ভূত ব্যবস্থা; যেমন—গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গায়েবি মামলাগুলো প্রবল হয়ে ওঠে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো আইন প্রণীত হয়।
২০১৪ সাল থেকে উপর্যুপরি দিবালোকে ডাকাতির ভোট, ভোট ছাড়াই বিজয়ী হওয়া এবং নিশিরাতের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের কোনো রকমের ম্যান্ডেট ছাড়াই শেখ হাসিনা ক্ষমতায় উপবিষ্ট থাকেন। এখানে যেটা লক্ষণীয় তা হচ্ছে, ২০১১ সালের পর থেকেই একটি স্বৈরাচারী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলেও তার একটা বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে—শেখ হাসিনার শাসন কেবল আরো বেশি স্বৈরাচারীই হয়ে ওঠে তা নয়, হয়ে ওঠে ব্যক্তিতান্ত্রিক।
অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় ক্ষমাতসীন ব্যক্তি তার শাসনকে দীর্ঘায়িত, সম্ভব হলে আজীবন, বহাল রাখার জন্য একাদিক্রমে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে একেবারেই ধ্বংস করে দিয়ে সেখানে অনুগত ব্যক্তিদের দিয়ে দেশ শাসন করে, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয় পরিবার এবং অর্থনীতি হয়ে ওঠে ক্লেপ্টোক্রেটিক বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সমর্থনপুষ্ট বিরাট আকারের চুরির পথ। বাংলাদেশে ২০১৪ সাল থেকে দৃশ্যত সীমিত গণতন্ত্রের আড়ালে এই পদ্ধতিই চালু হয়, যা ২০১৮ সালের পর খোলামেলাভাবে একটা বল প্রয়োগ নির্ভর ব্যবস্থায় পরিণত হয়। ফলে ২০১৪ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো, যার মধ্যে আইনসভা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, বিচার বিভাগ—সবই কার্যত এক ব্যক্তির প্রতিই অনুগত থেকেছে। আর ক্ষমতার নৈতিক বৈধতার অভাবে, এমনকি আইনি বিবেচনায়ও বৈধতার অভাবে, বল প্রয়োগ ছাড়া আর কোনোভাবেই সে ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ২০১৪ সালের এক দশক পরে গণ-অভ্যুত্থানের পর যেটা সহজেই চোখে পড়ছে তা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় কাঠামোই অনুপস্থিত হয়ে গেছে। এটা এক দিনে বা এক বছরে ঘটেনি, দৈব দুর্বিপাকেও ঘটেনি। যার একটি ফল হচ্ছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব দুর্বল করে ফেলা। এইসব করা সম্ভব হয়েছে কারণ বিরাজমান সংবিধানের ভেতরেই এক ব্যক্তির ক্ষমতার পথ উন্মুক্ত ছিল এবং আছে, জবাবদিহির প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ব্যবস্থা তৈরি করা হয়নি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অনুপস্থিত থেকেছে এবং জনগণের হাতে ক্ষমতা থাকেনি।
এ কারণেই ২০২৪ সালে অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রের সংস্কারের প্রশ্নটি সবার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বলা আবশ্যক যে রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের এই তাগিদ সমাজের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরেই ছিল। ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত সরকার এর একটি সীমিত দিক—রাজনৈতিক দলের দিকে নজর দেয় এবং সে বিষয়ে জনগণের উৎসাহ থাকলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। কেননা রাষ্ট্রকাঠামো, শাসনব্যবস্থা, সাংবিধানিক ও আইনি ব্যবস্থার মৌলিক দিকগুলো এড়িয়ে যে সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল, তা দৃশ্যত চমক সৃষ্টি করলেও তার বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না; ক্ষমতাসীনদের কোনো সুস্পষ্ট ধারণাও ছিল না এবং ক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের উত্থান জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ঘটেনি।
সংস্কারের এই তাগিদ শুধু রাষ্ট্র ও সরকারের কাছ থেকে এসেছে তা নয়, বরং এক দশকের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন সিভিল সোসাইটি সংগঠন এবং কয়েক বছর ধরে বিদ্যমান স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের মধ্যেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বলে এসেছে, তাদের বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেছে। আগস্ট মাস থেকে সারা দেশে বিভিন্নভাবে যেসব আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতেও যেসব মতামত প্রকাশিত হয়েছে, তাতে এটাই সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় যে মানুষের আগ্রহ শুধু আশু পরিবর্তনের মধ্যে সীমিত নয়। তারা চাইছে, গত প্রায় সাড়ে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা তাদের এই শিক্ষা দিয়েছে যে এর পুনরাবৃত্তি রোধের উপায় কেবল আশু একটি নির্বাচন নয়, বরং আরো বেশি। এই অভিজ্ঞতাকে তারা দেড় দশকের নিপীড়নের বা জুলাই-আগস্টের ম্যাসাকারের মধ্যেই সীমিত রাখছে না, কেননা এটা তাদের কাছে সহজেই বোধগম্য যে বিদ্যমান শাসনকাঠামো, সাংবিধানিক ব্যবস্থা ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে এমনকি আরেকটি সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব হলেও তা ভবিষ্যতে স্বৈরাচারী শাসকের উত্থান রোধ করতে সক্ষম নয়।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার এবং এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা শিক্ষার্থীরা সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বললেও আজকের সংস্কারের প্রশ্নকে অবশ্যই সরকারের বা শিক্ষার্থীদের ‘প্রত্যাশা’ বলে বিবেচনা করার উপায় নেই। কেননা ভেঙে পড়া রাষ্ট্রকাঠামো পুনর্গঠনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলোকে নতুন করে ঢেলে সাজানো দরকার। এই প্রক্রিয়া স্বল্প সময়ের কাজ নয়, কিন্তু তার সূচনা করা জরুরি। তার চেয়েও জরুরি যা তা হচ্ছে, স্বৈরাচারী ব্যবস্থার উত্থানের উৎসগুলো চিহ্নিত করা এবং কী কী আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার, যা এই ধরনের শাসনের উত্থান রোধ করবে সে বিষয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলোর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা।
এই ঐকমত্যকে কোনো অবস্থায়ই ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা বলে বিবেচনা করা সঠিক হবে না। এই ধরনের ঐকমত্যকে নাগরিকদের সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ‘সামাজিক চুক্তি’ বলেই বিবেচনা করতে হবে। এই ঐকমত্যকে যদি এইভাবে বিবেচনা করা না যায় এবং এই মর্যাদায় উন্নীত না করা যায় তাহলে তা শুধু কাগুজে বিষয়ে পরিণত হবে। এই বিবেচনায় অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা একার্থে সাহায্যকারীর। কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার যে এই সরকার দায়িত্ব নিয়েছে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিভূ হিসেবে। ফলে এই প্রক্রিয়ায় সাহায্যকারীর অবস্থান আর দশটি ক্ষেত্রে সাহায্যকারীর ভূমিকা ও অবস্থান থেকে ভিন্ন। তাঁরা সেই নাগরিকদেরও প্রতিনিধিত্ব করেন, যাঁদের প্রাণ ও রক্তের বিনিয়ে এই সংস্কারের এবং নতুন সামাজিক চুক্তির সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
লেখক: সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং ডিস্টিঙ্গুইশড প্রফেসর, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো
(দৈনিক কালের কণ্ঠের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত)
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০২৫