ঢাকা: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকেই প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবছে বাংলাদেশ। গত বছরের ৫ আগস্ট হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন।
শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ব্যাপক আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতার এই পটপরিবর্তন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে নতুন আকার দিয়েছে। এটি প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের শীতলতা কাটাতেও ভূমিকা রাখছে।
দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে পাকিস্তানের সাবেক সিনেটর, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা সচিব এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএলএন) গুরুত্বপূর্ণ নেতা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল আব্দুল কাইয়ুম বাংলানিউজকে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
প্রশ্ন: পাকিস্তান কীভাবে বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, বিশেষ করে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন ও আসন্ন নির্বাচনের বিষয়গুলো মূল্যায়ন করছে?
উত্তর: আমরা বাংলাদেশি জনগণ, বিশেষ করে তরুণ ও শিক্ষার্থীদের প্রতি সম্মান জানাই, যারা স্বৈরাচারী সরকারকে অপসারণ করেছে। ওই সরকার শুধু কয়েকশ’ শিক্ষার্থীকেই হত্যা করেনি, বরং তাদের মতাদর্শের বিরোধী এবং ক্ষমতার নির্মম ব্যবহার মেনে না নেওয়া বহু ধর্মীয় আলেমকে (চিন্তাবিদ) ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে।
প্রশ্ন: পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার আগামী ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় আসছেন। আসন্ন এই সফর নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী? এর মাধ্যমে পাকিস্তানের কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্যটি অর্জনের চেষ্টা করা উচিত?
উত্তর: বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে গভীর ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সম্পর্ক রয়েছে। (ব্রিটিশ শাসনামলে) ১৯০৬ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা ঢাকাতেই হয়েছিল। এর মাধ্যমে পরে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠনে সফলতা এসেছিল। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান দীর্ঘ ২৪ বছর একসঙ্গে ছিল। দুই দেশই সার্ক, ওআইসি ও কমনওয়েলথ অব নেশনসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের ঢাকা সফর সৌহার্দ্যপূর্ণ এক সফর হবে, যেখানে উভয় দেশের পারস্পরিক স্বার্থে সহযোগিতার সম্ভাব্য সব পথ অনুসন্ধান করা হবে।
প্রশ্ন: ইসহাকের সফরে কোন কোন চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হতে পারে এবং এসব চুক্তি উভয় দেশের জন্য কী ধরনের সুফল বয়ে আনবে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর: সফরে উভয় দেশের জন্য উপকারী সব গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সম্পাদিত হবে। এর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, নিরাপত্তা, যৌথ সামরিক মহড়া, পর্যটন এবং সার্ককে আরও কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
প্রশ্ন: দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক নানা চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নিয়ে পাকিস্তান কি এই সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন এবং নতুন একটি অধ্যায় শুরুর সুযোগ হিসেবে দেখছে? যদি তা হয়, সেক্ষেত্রে মূল ক্ষেত্রগুলো কী হতে পারে?
উত্তর: নিঃসন্দেহে এটি একটি চমৎকার সুযোগ, যেখানে আমরা অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো ভুলে গিয়ে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পুনরায় সাজাতে পারি। আমাদের প্রতিবেশী ভারতের আঞ্চলিক উচ্চাভিলাষ সবসময়ই প্রকাশ পেয়েছে। তারা আমাদের সম্পর্কের মধ্যে বিভেদ তৈরি করার চেষ্টা করেছে। ভারত কখনোই তার পূর্ব-পশ্চিম দিকে থাকা শক্তিশালী ও সার্বভৌম মুসলিম দুই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেনে নিতে পারেনি। আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত— অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানো, বার্ষিক বাণিজ্য দুই বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে আরও বাড়ানো, ফ্লাইট চলাচল পুনরায় চালু করা, পর্যটকদের জন্য ভিসা সহজ করা, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সই করা এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর ওপর কূটনৈতিক ঐকমত্য গঠন করা।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন কোন কারণে হয়েছে বলে আপনি মনে করেন? সম্পর্কগুলো কীভাবে পাকিস্তানের বৃহত্তর আঞ্চলিক কৌশলগত লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
উত্তর: পাকিস্তানও বাংলাদেশের মতো একটি শান্তিপ্রিয় দেশ। আমাদের কৌশলগত লক্ষ্য হলো দক্ষিণ এশিয়ায় মিলেমিশে থাকার একটি পরিবেশ তৈরি করা, সব প্রতিবেশীর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা এবং দেশগুলোকে আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি সামাজিক কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করতে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো।
প্রশ্ন: পাকিস্তান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতের ক্রমবর্ধমান কৌশলগত প্রভাবকে কীভাবে দেখে? বিষয়টি পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কের ওপর কী প্রভাব ফেলবে?
উত্তর: বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র। দেশটি এখন যেকোনো বাহ্যিক চাপ প্রত্যাখ্যান করার সাহস রাখে। আমরা আশা করি, প্রতিবেশীদের দমনের নীতি থেকে ভারত বিরত থাকবে। তারা নিজেই এক বিশাল দেশ। দুঃখজনকভাবে দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত জনগণের আবাসস্থল। বর্তমানে সেখানে বেশ কয়েকটি বিদ্রোহ এবং মুক্তি আন্দোলনও চলছে। ভারতের উচিত তার অভ্যন্তরীণ সমস্যা— ক্ষুধা ও সংখ্যালঘু নির্যাতন গুরুত্ব সহকারে সমাধান করা। একদিকে ভারত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার প্রত্যাশা করছে। কিন্তু অন্যদিকে কাশ্মীর নিয়ে জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। তাদের (ভারত) অবশ্যই পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদ ছড়ানোর ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, যেমনটি সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। তাদের উচিত মুসলিম, খ্রিষ্টান ও শিখদের সমান নাগরিক হিসেবে গণ্য করা।
প্রশ্ন: দক্ষিণ এশিয়ার জটিল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় পাকিস্তান কীভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার পাশাপাশি ভারত ও চীনসহ অন্যান্য আঞ্চলিক ক্রীড়নকদের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক বজায় রাখবে?
উত্তর: দুঃখজনকভাবে ভারত কখনোই দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো দেশের সঙ্গে পাকিস্তানের ভালো সম্পর্ক দেখতে চায় না। বিশেষ করে ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে। বাংলাদেশ-পাকিস্তানের হৃদয়ের অংশ হিসেবেই রয়ে গেছে। কারণ, আমাদের মতাদর্শ এক, বিশ্বাস এক এবং আমরা উভয়ই ভারতীয় সন্ত্রাসবাদী হামলার শিকার। আর চীন আমাদের ভালো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রশংসা করবে। কেননা উভয় দেশেরই চীনের সঙ্গে সর্বোচ্চ বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশই চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড) সুফলভোগী।
প্রশ্ন: শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে নামমাত্র বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। আপনি কী মনে করেন, ভারতের প্রভাব বাংলাদেশের মধ্যে পাকিস্তানের এই অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করেছে?
উত্তর: শেখ হাসিনার সময়কালে আমাদের বার্ষিক দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এক বিলিয়ন ডলারেরও কম ছিল। ২০২২ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে ৮৩৯ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে, রপ্তানি করে মাত্র ৭৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। নিঃসন্দেহে বাণিজ্য সম্প্রসারণের বিশাল সুযোগ রয়েছে।
প্রশ্ন: পাকিস্তান কী ধরনের বিশেষ উদ্যোগ বাংলাদেশের কাছ থেকে আশা করছে যা পারস্পরিক আস্থা গড়ে তুলতে এবং দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বাড়াতে সাহায্য করবে?
উত্তর: অর্থনৈতিক সহযোগিতা, উন্নত পার্লামেন্টারি সম্পর্ক, পুনরায় ফ্লাইট চলাচল শুরু করা এবং পর্যটন ক্ষেত্রের মতো উদ্যোগগুলো গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বালুকাময় সৈকত, প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, ঐতিহাসিক মসজিদ, স্মৃতিসৌধ, পাহাড়ি বনাঞ্চল, বন্যপ্রাণী এবং অত্যন্ত আতিথেয়তাপূর্ণ জনগণ রয়েছে। অন্যদিকে, বিশ্বের ১৪টি সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের মধ্যে আটটিই পাকিস্তানে অবস্থিত, যার মধ্যে কে-টু দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। সিন্ধুর মরু অঞ্চল, সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যপূর্ণ উত্তরাঞ্চল ও কাশ্মীর এবং এক হাজার ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্রতট বিনিয়োগকারী ও পর্যটকদের জন্য অসংখ্য সুযোগের দ্বার উন্মুক্ত করবে।
প্রশ্ন: পাকিস্তান সার্কসহ অন্যান্য আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে ইসলামাবাদ ও ঢাকার মধ্যে দূরত্ব কমানো এবং সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে কী ভূমিকা আশা করে?
উত্তর: বাংলাদেশ কখনোই পাকিস্তানের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। শেখ হাসিনার মনোভাব যদিও ভারতের প্রতি নির্লিপ্ত ছিল, তবুও আমাদের পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ইনশাআল্লাহ চিরস্থায়ী হবে। আমরা উভয়ই সার্ক ও অন্যান্য আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্মগুলোকে আমাদের পারস্পরিক উপকারের জন্য আরও শক্তিশালী করতে পারি।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য কোন খাতগুলো সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময়?
উত্তর: পাকিস্তান তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য, মাছ, চিংড়ি, কৃষিপণ্য, ওষুধ ও প্লাস্টিক পণ্য বাংলাদেশ থেকে আমদানি করতে পারে এবং চাল, আসবাবপত্র, টেক্সটাইল, স্বাস্থ্যসামগ্রী, মূল্যবান পাথর, ইস্পাত ও সিমেন্ট সেদেশে রপ্তানি করতে পারে।
প্রশ্ন: ভাবমূর্তি উন্নয়ন এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়াতে পাকিস্তান কীভাবে বাংলাদেশের গণমাধ্যম এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনের পরিকল্পনা করছে?
উত্তর: এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমরা ইংরেজিতে ভাষান্তরিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রিন্ট করা সংবাদপত্র ও টিভি প্রোগ্রাম আদান-প্রদান করতে পারি। টক শো আয়োজন করা যেতে পারে এবং ডকুমেন্টারি বিনিময় করা যেতে পারে।
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালের যুদ্ধের কারণে যে ইতিহাসগত সংবেদনশীলতা এখনো রয়েছে, পাকিস্তান কীভাবে তা দেখে এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতির জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
উত্তর: যারা ভুল নীতি, দুর্বল শাসন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্রের মতো ঘটনায় জড়িত ছিলেন, তারা ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের যে বিশাল গল্প প্রচার করা হয়েছিল, তা ছিল অতিরঞ্জিত। মুক্তিবাহিনীর ছদ্মবেশে র’এর (ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা) হাতে অ-বাঙালিরা নির্যাতন এবং হত্যাকাণ্ডেরও শিকার হয়েছিলেন। আমাদের উচিত ভুল-ত্রুটি ভুলে ক্ষমা করে সামনে এগিয়ে যাওয়া। দুই পক্ষকেই সব ধরনের অন্যায় কাজের নিন্দা করতে হবে এবং অশোভন কাজের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। পাকিস্তানিরা বাঙালি ভাইদের ভালোবাসে এবং কোনো সন্দেহ নেই যে তাদেরও একই অনুভূতি বিদ্যমান।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০২৫
আরএইচ