দিনাজপুর: বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রতভাবে মিশে আছে গ্রামীণ জনপদের মেলা। যে সময় টেলিভিশন, মোবাইল ফোন কিংবা ইন্টারনেটের ব্যবহার ছিল না তখন বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল গ্রাম্যমেলা।
নাগরদোলা, পুতুল নাচ, ঘরবাড়ির প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, জিলাপি- মিষ্টিসহ বিভিন্ন খাবারের দোকান নিয়ে জমজমাট হতো এসব মেলা। সঙ্গে থাকতো গরু-মহিষ, ঘোড়াসহ বিভিন্ন পশু বিক্রির মহোৎসব। তেমনি এক মেলার নাম 'বাংলাদেশ চেরাডাঙ্গী মেলা'।
দিনাজপুর সদর উপজেলার ৬ নম্বর আউলিয়াপুর ইউনিয়নের চেরাডাঙ্গী এলাকায় অনুষ্ঠিত হয় এই মেলা। প্রতিবছর ২৩ মাঘ এই মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
চেরাডাঙ্গী মেলার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ঘোড়ার হাট। দিনাজপুর, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, নওগাঁ, রাজশাহীসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে অনেকেই ঘোড়া কিনে বিক্রি করতে আসেন এই মেলায়। ঐতিহ্যবাহী চেরাডাঙ্গী মেলায় কমেছে ঘোড়ার সংখ্যা। একই সঙ্গে কমেছে ঘোড়ার দাম। প্রাকৃতিক খাদ্য সংকট, দানাদার খাদ্য দাম বৃদ্ধি, ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন কমে যাওয়াসহ সহজ নানা কারণেই ঘোড়া পালনে ভাটা পড়েছে বলে জানান মেলায় আসা বিক্রেতারা। এ মেলায় গরু ছাগলের দামেই মিলছে ঘোড়া।
ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী থেকে এসেছেন ঘোড়া বিক্রেতা দেলোয়ার হোসেন কবির। কথা হলে তিনি জানান, দেশ স্বাধীনের আগে থেকেই আমরা ঘোড়া পালন করে আসছি। আমার বাপ-দাদারাও ঘোড়া পালন করত। এটা একটা শখ। এখন তো ঘোড়ার কদরই নেই। মানুষ ঘোড়া পালন করে না তেমন একটা। প্রাকৃতিক খাদ্য নেই, খাবারের দাম বেশি, রাস্তাঘাট পাকা হয়েছে। ঘোড়ার চাহিদা কমে যাওয়ায় দামও কমে গেছে।
রাজশাহী থেকে আসা আব্দুল হাকিম বলেন, দিনদিন ঘোড়া প্রচলন কমে যাচ্ছে। আগে যেরকম ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা হত বর্তমানে তা তেমন একটা দেখা যায়। ঘোড়ার প্রাকৃতিক খাবারও কমে গেছে। মানুষের ঘোড়া পালনের ইচ্ছেও কমে গেছে। অনেকেই আগে শখের বশে ঘোড়া পালন করতেন। কিন্তু আমাদের সবার উচিত এই ঘোড়ার ঐতিহ্যকে ধরে রাখা। খেলাধুলা হলে যুবসমাজ আর মাদকের দিকে ধাবিত হবে না। মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থা হবে। এটা সম্ভব না হলে এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে ঘোড়া এবং ঘোড় দৌড়।
তবে ভালো জাত ও ভালো আকারের ঘোড়ার দাম রয়েছে বলে জানান ক্রেতারা। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী থেকে আসা ঘোড়া ক্রেতা আব্দুল কাদির বলেন, আগের মতো চেরাডাঙ্গী মেলায় ঘোড়া আসে না। ঘোড়ার সংখ্যা কমে গেছে। ভালো জাতের ঘোড়া তেমন নেই। কিন্তু ঘোড়া তো আমাকে নিতেই হবে। একটা ঘোড়া পছন্দ হয়েছে। ৮০ হাজার দাম চাচ্ছে, ৪৫ হাজার বলেছি। ভালো ঘোড়ার ভালো দাম রয়েছে।
দিনাজপুরের বিরল উপজেলার কামদেবপুর এলাকা থেকে ঘোড়া কিনতে আসা আব্দুর রশিদ বলেন, আমি প্রায় ৩০ বছর ধরে ঘোড়া পালন করে আসছি। এটা একটা শখ। গত বছরের চেয়ে এবার ঘোড়ার দাম বেশি হলেও বিগত কয়েক বছরের তুলনায় কম। আগে যে ঘোড়ার দাম ৫০ হাজার ছিল, এখন সেই ঘোড়া ২০ হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। ঘোড়া পালন করে লাভ কেউ করতে পারবে না। তবুও শখ করে পালন করছে।
ঐতিহ্য ধরে রাখতে ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার বলে জানান মেলায় আসা দর্শনার্থীরা।
সদর থেকে আসা আবুল কালাম আজাদ বলেন, বর্তমান প্রজন্মের অনেক বাচ্চাই আমাদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অনেক বাচ্চাই আছে যারা ঘোড়া কাছে থেকে দেখেনি, ছুঁয়ে দেখা তো অনেক বড় বিষয়। ঘোড়ার ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমাদের এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। নাহলে হয়তো এক সময় বাংলাদেশ থেকে ঘোড়ার অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে।
সদর উপজেলার কাশিমপুর এলাকার আমিনুল ইসলাম বলেন, চেরাডাঙ্গীর মেলায় আগে অনেক ঘোড়া আসতো। এখন তো তুলনামূলক অনেক কম আসে। প্রাকৃতিক খাদ্য সংকট, দানাদার খাদ্যের দাম বেশি, শখ করে তো এখন আর তেমন কেউ ঘোড়া পোষে না। লাভ না হলে তো সেই ব্যবসা কেউ করতে চাইবে না। ঘোড়ার গাড়ি, ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা এজাতীয় কিছু উদ্যোগ নিলে হয় তো ঘোড়ার কদর বাড়বে।
বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ৭৮তম 'বাংলাদেশ চেরাডাঙ্গী মেলা'র উদ্বোধন করেন জেলা বিএনপির সভাপতি ও সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মোফাজ্জল হোসেন দুলাল। এসময় জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি হাফিজুর রহমান, চেরাডাঙ্গী মেলার সভাপতি রাশেদ-উজ-জামান (রুপন), সাধারণ সম্পাদক মাজেদুর রহমান মাজেদসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।
১৯৪৮ সাল থেকে চলে আসছে ঐতিহ্যবাহী চেরাডাঙ্গী মেলা। মেলার সার্বিক নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা। বাংলাদেশ সময়: ১১০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২৫
আরএ