ঢাকা: বাাংলাদেশ পুলিশ বল প্রয়োগে ৫ টি ধাপের একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এ নিয়ে পুলিশ সংস্কার কমিশনে বিস্তর আলোচনা হয়েছে।
শনিবার (০৮ ফেব্রুয়ারি)পুলিশ সংস্কার কমিশনের বলপ্রয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে কমিশন এসব সুপারিশ করেছ ৷ এর আগে দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার কাছে পুলিশ সংস্কার কমিশন তাদের চূড়ান্ত সুপারিশ জমা দিয়েছেন।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, ১৮৯৮ সনের ফৌজদারি আইন, ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন, ১৯৪৩ সনের বেঙ্গল পুলিশ রেগুলেশন্স (পিআরবি)'র যথাযথ অনুসরণ করে এবং সেসঙ্গে সময়ের বিস্তর ব্যবধানে আধুনিক বিশ্বে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে যে সকল প্রযুক্তিগত কৌশল ব্যবহার করা হয় তা বিবেচনায় নিয়ে বাাংলাদেশ পুলিশ কর্তৃক ০৫ (পাঁচ) ধাপে বল প্রয়োগের একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এ নিয়ে পুলিশ সংস্কার কমিশনে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। বিষয়টি ধর্তব্যে নিয়ে কমিশনের প্রণীত ধাপগুলোকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী কর্তৃক বল প্রয়োগের জন্য নির্ধারিত নীতিমালা অনুসরণ করে সুবিন্যস্ত করা হয়েছে। এজন্য আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।
এই পদ্ধতি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনুসরণের জন্য আইনগত বৈধতা দিয়ে প্রতিপালনের জন্য কমিশন মধ্যমেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে সুপারিশ করছে। এতে ন্যূনতম ক্ষতি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, এমনকি কোনো প্রাণহানির ঝুঁকিও এড়িয়ে চলা সম্ভপর হবে।
বলপ্রয়োগের জন্য ব্যবহৃত ৫টি ধাপ হলো:
স্তর-১ শারীরিক সংস্পর্শ ব্যতীত উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে বাধা প্রদান (পিআরবি ও জাতিসংঘ মানদণ্ড):
সংঘবদ্ধ জনতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সার্ভিসের সদস্যগণের সঙ্গে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে জড়ো হতে থাকলে সাধারণ ইউনিফর্মে পুলিশ সদস্যদের এমনভাবে নিয়োজিত করতে হবে, যাতে উপস্থিত জনসাধারণ নিরাপদ বোধ করেন। সংঘবদ্ধ জনতা মিছিল, সমাবেশ বা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রদর্শন করার প্রবণতা দেখালে পুলিশ সদস্যরা নিরাপদে দৃশ্যমানভাবে নিয়োজিত হবেন, যাতে মিছিল-সমাবেশে অংশগ্রহণকারী জনতাকে অবৈধ ঘোষণা করা হলে এবং ছত্রভঙ্গ হওয়ার আহ্বান জানালে, তারা যেন সহজতম পথে সেই স্থান ত্যাগ করতে পারেন। এই স্তরে পুলিশের উপস্থিতিতে মিছিল-সমাবেশ করা জনতা ও চতুর্পার্শ্বের সাধারণ জনগণ নিরাপদ বোধ করেন এবং অবৈধ উদ্দেশ্য সাধনে জড়ো হওয়া জনতার ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি হয়। এই পর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে মিছিল, সমাবেশে অংশগ্রহণকারী জনতার কোনো শারীরিক সংস্পর্শ হয় না এবং কোনো বিশেষ ক্রাউড কন্ট্রোল টেকনিক জনতার ওপর প্রয়োগ করতে হয় না। পুলিশ কর্তৃক সংঘবদ্ধ জনতাকে অবৈধ ঘোষণা করা হলে তারা যদি ছত্রভঙ্গ না হয়ে অধিক শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে তবে পুলিশ সদস্যরা ক্রাউড কন্ট্রোল গিয়ার যথা: ধাতব হেলমেট, বুলেট প্রুফ জেকেট, লেগ গার্ড, আর্ম গার্ড, থাই গার্ড, গ্যাস মাস্ক ইত্যাদি পরিধান করবেন এবং জনতার গতিবিধির উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখবেন।
স্তর-২ নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা (পিআরবি ও জাতিসংঘ মানদণ্ড):
এই পর্যায়ে জড়ো হওয়া জনতাকে পুলিশ কর্তৃক বেআইনি ঘোষণা করা হলেও তারা ছত্রভঙ্গ না হওয়ার প্রবণতা দেখায়। অবৈধ জনতা পুলিশ সদস্যদের ক্লোজ কন্টাক্টে আসে বা আসার চেষ্টা করে। সংঘবদ্ধ জনতা নিয়ন্ত্রণে অংশগ্রহণকারী পুলিশ সদস্যরা
রোড ব্লক, ক্লিয়ারিং ওয়েব, অফেন্সিভ জাম্প কৌশল প্রয়োগ করার মাধ্যমে জনতার সঙ্গে নিজেদের নিরাপদ দূরত্ব সৃষ্টি করে (পিআরবি ১৫২ (২) শারীরিক ইনজুরির পরিমাণ কমিয়ে আনেন ও নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা অবৈধ জনতার দখলমুক্ত করে নিজেদের আওতায় নিয়ে আসেন (পুলিশ আইন, ১৮৬১ এর ধারা ৩০, ৩০এ; ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ধারা ১২৭, ১২৮; দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ধারা ১৪৪; পিআরবি'র ১৯৪৩ প্রবিধি ১৪৩, ১৪৪, ১৫২(২))।
স্তর-৩ বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে অবৈধ জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা (পিআরবি ও জাতিসংঘ মানদণ্ড):
বারংবার সমঝোতার চেষ্টা ও সতর্কবাণী উচ্চারণ করার পরও বেআইনি সমাবেশের জনতা সংঘবদ্ধ থাকলে এবং ছত্রভঙ্গ হওয়ার প্রবণতা না দেখিয়ে কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য নিম্নোক্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি করলে: ক) সমাবেশ ও মিছিলের স্থান বা চলাচলের পথ আইনসঙ্গতভাবে নিয়ন্ত্রণ করার পরও যদি অনুমোদনহীন এলাকা সমাবেশ বা মিছিল করে অতিক্রম করে, যার ফলে সাধারণ মানুষের জানমাল ও সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে;
খ) বেআইনি ঘোষিত সমাবেশকে ছত্রভঙ্গ হওয়ার আহ্বান জানানোর পরও স্থান ত্যাগ না করলে;
গ) কোনো এলাকায় প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে রোড ব্লক, চেক পয়েন্ট বা নিরাপত্তা বেষ্টনী গঠন করা হলে জনতা যদি অবৈধভাবে সেখানে জোরপূর্বক প্রবেশের চেষ্টা করে;
ঘ) কোনো গ্রেপ্তারকৃত বা আটক অপরাধীদের পলায়ন প্রতিরোধ বা তাদের ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য উচ্ছৃঙ্খল জনতা আক্রমণ, ইত্যাদি করলে কর্ডন, ক্লিয়ারিং ওয়েব, ব্যাটন চার্জ ইত্যাদি কৌশল প্রয়োগ করে এবং গ্যাস স্প্রে, সাউন্ড হ্যান্ড গ্রেনেড, জলকামান, গ্যাস/স্মোক ক্যানিস্টার ও লঞ্চার, হ্যান্ড স্টান ক্যানিস্টার, সফট কাইনেটিক প্রজেক্টাইল লঞ্চার, পিপার স্প্রে, শটগান, ইলেকট্রিক পিস্তল (টিজার গান) প্রভৃতি ব্যবহার করে অবৈধ জনতাকে ছত্রভঙ্গ বা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এই পর্যায়ে অবৈধ জনতাকে সক্রিয়ভাবে বাধা দিতে হয় এবং তাদের পক্ষ থেকে চাপের সম্মুখীন হতে হয়। প্রয়োজনে পরিস্থিতি বিবেচনায় ফ্রন্ট, লিথেল অ্যাম্বুশ অ্যারেস্ট টেকনিক অনুসরণ করে দলনেতা ও অন্যান্য গোলযোগে উসকানিদাতা অবৈধ জনতাকে গ্রেপ্তার করতে হবে।
স্তর-৪ প্রাণঘাতী বা ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার (পিআরবি ও জাতিসংঘ মানদণ্ড):
বিভিন্ন কৌশলে শক্তি প্রয়োগ করেও অবৈধ জনতা ছত্রভঙ্গ না হলে বরং আরও সংঘটিত হওয়ার প্রবণতা দেখিয়ে মারমুখী আচরণ করলে ব্যাপক ভাঙচুরের ঘটনা ঘটালে এবং পুলিশ ও সাধারণ জনগণকে আঘাত করে আহত করলে কমান্ডার তার সদস্যদেরসহ আড় (কাভার) নেবেন। জল কামান, এপিসি ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে Specific Skills প্রয়োগ করে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। প্রয়োজনে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে শট গান, সাউন্ড গ্রেনেড, একক বা ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র নির্দিষ্ট টার্গেটে ব্যবহারের মাধ্যমে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করবেন। এই পর্যায়ে অবৈধ উচ্ছৃঙ্খল জনতার আক্রমণের কারণে জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, শারীরিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয় এবং কমান্ডার ও পুলিশ সদস্যদের এই পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ সহনশীলতার পরিচয় দিতে হয়। কেউ আহত হলে কমান্ডার সঙ্গে সঙ্গেই অন্য সকল কৌশল বন্ধ রেখে অ্যাম্বুলেন্সে আহত সদস্যদের ক্যাজুয়াল্টি ইভাক্যুয়েশনের ব্যবস্থা করবেন। এই স্তরে আত্মরক্ষামূলক কৌশল অবলম্বন করতে হবে। জনতার ওপর গুলিবর্ষণের নির্দেশকে একটি চরম ব্যবস্থা হিসাবে গণ্য করতে হবে এবং কেবলমাত্র পুলিশ সদস্যদের বা ব্যক্তির আত্মরক্ষা বা সম্পত্তি রক্ষার অধিকার প্রয়োগের জন্য প্রযোজ্য হবে (পিআরবি'র প্রবিধি ১৫৩(ক), (খ), (গ))। তবে যে পরিস্থিতি ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগে বাধ্য করেছে তা প্রমাণ করার দায়িত্ব আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারকারীর ওপর বর্তায় (সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এর ধারা ১০৫; পিআরবি'র প্রবিধি ১৫৩ (খ))।
স্তর- ৫ দলগত আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার (পিআরবি ও জাতিসংঘ মানদণ্ড):
বেআইনি সমাবেশের দলনেতা ও অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য সমঝোতার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে এবং বারংবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করার পরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে বরং অবৈধ ঘোষিত জনতা নতুন শক্তি সঞ্চয় করে নিম্নোক্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি করলে:
৫(ক). যাতে দেহের বা সম্পত্তি সম্পর্কিত ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার অধিকার ক্ষুণ্ন হয় (১৮৬০ সালের পেনাল কোডের ১০০, ১০৩ ধারা)। যথা:
১) এরূপ আক্রমণ যা এমন যুক্তিসঙ্গত আতঙ্ক সৃষ্টি করে যে প্রকারান্তরে মৃত্যু বা গুরুতর আঘাতই হবে অনুরূপ আক্রমণের পরিণতি;
২) সাধারণ মানুষ বা পুলিশ সদস্যদের অপহরণ বা আটকের অভিপ্রায়ে আক্রমণ;
৩) গুরুতর প্রকৃতির অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধ করার জন্য যার ফলশ্রুতিতে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে;
৪) বাসগৃহ বা সম্পত্তি সংরক্ষণের স্থানরূপে ব্যবহৃত হয় এমন ইমারত, ভবনে অগ্নিসংযোগ করে ক্ষতিসাধন করলে;
৫) ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াও করে তাণ্ডবলীলা চালিয়ে সাধারণ মানুষ ও পুলিশ সদস্যদের হতাহত করলে ও জানমালের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করলে ইত্যাদি।
৫ (খ). বেআইনি জনসমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে ক্রাউড কন্ট্রোল টেকনিকের বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে ব্যর্থ হলে যখন জানমাল ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে তখন চরম ব্যবস্থা হিসেবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতিসাপেক্ষে দক্ষ শ্যুটার দিয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কালেক্টিভ ফায়ার আর্ম ব্যবহার করিয়ে আক্রমণকারীকে প্রতিহত করার জন্য গুরুতর আঘাত এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটানো যেতে পারে। দেহ বা সম্পত্তি সম্পর্কিত ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার অধিকার যুক্তিযুক্ত আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ হয় এবং যতক্ষণ আতঙ্ক অব্যাহত থাকে ততক্ষণ বলবৎ থাকে। তবে কখনোই এই সশস্ত্র শক্তি প্রয়োগ প্রয়োজনের অতিরিক্ত আরোপ করা যাবে না এবং অবৈধ জনতা ও আক্রমণকারীরা ছত্রভঙ্গ হওয়ার প্রবণতা দেখালেই শক্তি প্রয়োগের মাত্রা কমিয়ে আনতে হবে। এই পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে প্যারা মিলিটারি ও অন্যান্য ফোর্সের সাহায্য গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০১১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯,২০২৫
জিসিজি/এমএম