ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ চৈত্র ১৪৩১, ১৮ মার্চ ২০২৫, ১৭ রমজান ১৪৪৬

জাতীয়

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ

ড. ইউনূসের দর্শন বাস্তবায়ন দরকার

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪০ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০২৫
ড. ইউনূসের দর্শন বাস্তবায়ন দরকার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ফাইল ছবি

সারা দেশ এখন নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার। মাগুরায় আট বছরের শিশু আছিয়ার মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর সারা বাংলাদেশ যেন শোক-আবেগে ক্ষুব্ধ।

এ সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে নারী নিপীড়নের ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে বড় হয়ে আসছে। সারা দেশের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে নারীরা নিরাপত্তার এবং নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে এখন রাজপথে। ধর্ষকদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ। অনেকেই মনে করেন, ধর্ষক এবং নিপীড়কদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান না থাকায় এ ধরনের অপরাধ বাড়ছে। কেউ কেউ মনে করেন, বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি  হয়েছে, যে কারণে নিপীড়করা আশকারা পাচ্ছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে অপরাধী যে-ই হোক তার বিচার করতে হবে। তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। এ ধরনের ঘৃণ্য জঘন্য অপরাধের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের বিচার দ্রুততম সময়ের মধ্যে হওয়া উচিত। এ নিয়ে কারও কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু সংকটের উৎস মূলে যেতে হবে। কেন এ ধরনের ঘটনাগুলো বারবার ঘটছে? কেন বিভিন্ন স্থানে, এমনকি শিশুরা পর্যন্ত ধর্ষিত হচ্ছে একের পর এক। নারীর প্রতি সহিংসতা এবং নারী নির্যাতন কেন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাচ্ছে? এটা কী সাম্প্রতিক সময়ে প্রবণতা, নাকি এখন আমরা নতুন করে এটিকে অনুভব করছি? বাংলাদেশে নারী নিপীড়নের ঘটনা নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো আমাদের সমাজে চারপাশে ঘটে চলেছে। মাঝে মাঝে কোনো ঘটনা আমাদের আবেগতাড়িত করে। আমরা ক্ষোভে ফুঁসে উঠি। আবার কদিন পরে সেটি থিতিয়ে যায়। আমাদের নিশ্চয় মনে আছে, নুরজাহান কিংবা তনুর কথা। এই ঘটনাগুলো আমাদের আতঙ্কিত, উদ্বিগ্ন এবং বিক্ষুব্ধ করেছিল বিগত সময়ে। কিন্তু নারী নির্যাতন এবং নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধের জন্য কেবল শুধু আইন যথেষ্ট নয়, সঙ্গে প্রয়োজন আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমরা যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, তার সঙ্গে এখনকার যে নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো ঘটছে, তা মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ’ 

তিনি বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশের চেতনার সঙ্গে এসব ঘটনা সাংঘর্ষিক, বিপরীত। ’ প্রশ্ন উঠেছে যে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধের জন্য কী করা উচিত? নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধের পথনির্দেশ আমরা পেতে পারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চিন্তা ও দর্শনের মধ্যেই। ড. ইউনূস মনে করেন, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে প্রথমে যেটি করা উচিত, তা হলো আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। আর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের জন্য নারীর ক্ষমতায়ন অত্যন্ত জরুরি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল আবিষ্কার করেছিলেন এবং যে মডেল আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত সেই মডেলে নারীর ক্ষমতায়নের একটি বিন্যস্ত রূপকল্প রয়েছে। আমরা দেখেছি যে গ্রামীণ ব্যাংকের এই মডেল প্রত্যন্ত গ্রামে বাস্তবায়নের পর বাংলাদেশে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং নারী নিপীড়ন কিছুটা হলেও কমেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের নারী সদস্যরা তুলনামূলক কম নিপীড়নের শিকার। নারীর ক্ষমতায়নের মডেল যদি আর্থসামাজিক অবকাঠামোর মধ্যে প্রতিস্থাপন করা যায়, তাহলে নারীর প্রতি সহিংসতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে বলে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দর্শনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা গ্রামীণ ব্যাংকের মডেলে নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করলে একদিকে যেমন সমাজে পুরুষদের নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাবে, নারীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখবে অন্যদিকে নারীর এই ক্ষমতায়ন নারীকে স্বাবলম্বী করবে এবং তার স্বাধীনতা, অধিকার আদায়ের পথ দেখাবে। এই দুটি সমন্বয়ের ফলে আমরা একটি সহনীয় সমাজ পাব, যে সমাজে নারীর প্রতি নির্যাতন এবং নিপীড়ন কম হবে। নারীর প্রতি সহিংসতাগুলো আইনের আওতায় আসবে।  প্রথমে আমাদের দেখতে হবে যে নারীর প্রতি সহিংসতাগুলো ঘটছে কেন বা এটা নিয়ে সচেতনতা হচ্ছে, বিভিন্ন মহল থেকে ক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজপথ, তারপরেও এই সহিংসতাগুলো বন্ধ হচ্ছে না কেন? বন্ধ না হওয়ার একটা বড় কারণ হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি। আমরা এসব ধর্ষণ, নির্যাতন, নিপীড়নের বিচার সঠিকভাবে অতীতে করতে পারেনি। বিচার মাঝপথে থমকে গেছে। কারণ হলো, যারা এই অপরাধ করেছে তারা ক্ষমতাবান। অন্যদিকে যেসব নারী ভিকটিম হয়েছে, তারা এতই ক্ষমতাহীন এবং অধিকারহীন যে তারা এই মামলাগুলো দীর্ঘ প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য অর্জন করতে পারেনি। আর এখানেই আসে নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি। এখানেই আসে গ্রামীণ ব্যাংকের মডেলের কথা।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৭৬ সালে জোবরা গ্রামের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের যে মডেল শুরু করেছিলেন, সেই মডেলের একটি বড় দিক ছিল নারীর ক্ষমতায়ন। গ্রামীণ ব্যাংকের নারীদের অংশগ্রহণ এবং নারীদের ঋণ প্রদানের হার ৯০ শতাংশেরও বেশি। সবশেষ হিসাবে দেখা যায় যে গ্রামীণ ব্যাংকের আড়াই হাজারের বেশি শাখা থেকে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ গ্রাহককে ঋণ দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে ৯৭ শতাংশই হলেন নারী। আমরা যদি গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মসংস্থানের হার দেখি, সেখানে আমরা দেখব ৯৬ দশমিক ৮১ শতাংশ নারী অংশগ্রহণ রয়েছে। এটি গ্রামাঞ্চলে নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারী নিপীড়ন বন্ধে একটি নীরব বিপ্লব ঘটেছে। আমরা যদি একটু বিশ্লেষণ করে দেখি যেসব জেলা বা স্থানগুলোতে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম বিস্তৃত এবং যেসব নারী গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ গ্রহণ করেছেন এবং স্বাবলম্বী হয়েছেন, গ্রামীণ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের ক্ষুদ্র সামাজিক ব্যবসার কার্যক্রম আত্মনির্ভর হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। এসব নারী একদিকে যেমন সামাজিকভাবে মর্যাদাবান হয়েছেন, অন্যদিকে তাদের পারিবারিক এবং সামাজিক নির্যাতনের হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বিশেষ করে নারীরা যখন শিক্ষিত এবং অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভর হন তখন তার ওপর সহিংসতার মাত্রাটা অনেকটাই কম হয়। আমরা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখেছি যে অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভর নারীরা গৃহে যতটা নির্যাতনের শিকার হন, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী এবং অর্থনৈতিকভাবে ক্রিয়াশীল নারীরা সে তুলনায় অনেক কম নিপীড়নের শিকার হন। আর এখানেই হলো ড. ইউনূসের চিন্তার বাস্তব প্রয়োগের সাফল্য। তিনি সব সময় অনুধাবন করতেন যে আমাদের সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্য, নারী নিপীড়ন এবং নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধের জন্য নারীকে শক্তিশালী করতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন করতে হবে। এ কারণেই তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের মডেলকে কেবল নারীর সম্পৃক্ততাকে প্রধান করে তোলেননি, বরং গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে যে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো করা হয়েছে, যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীদের অর্থনৈতিক চাঞ্চল্য এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে যেমন গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ উদ্যোগ, গ্রামীণ সল্যুশন, গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড, গ্রামীণ শিক্ষা ইত্যাদি। অর্থাৎ এসব প্রতিষ্ঠান কেবল আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং প্রান্তিক জনপদের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করছে না, বরং নারী জাগরণের কাজ করে যাচ্ছে নীরবে, জোরেশোরে। আর এ কারণেই তিনি নারীর মুক্তির একটি সামষ্টিক রূপ আবিষ্কার করেছেন। ড. ইউনূসের দর্শন হলো একজন কন্যাশিশুকে ছোট থেকেই সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। তাকে বিকশিত করতে হবে। তার শিক্ষার সুব্যবস্থা করতে হবে এবং তখন তাকে বাল্যবিয়ে থেকে দূরে রাখতে হবে। উপযুক্ত শিক্ষার পর তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। গ্রামীণ ব্যাংক এই মডেলের মাধ্যমে বহুমাত্রিক কর্মসূচির মাধ্যমে একটি নারী জাগরণের নীরব বিপ্লবের কাজ করে যাচ্ছে। এর ফলে সারা দেশে নীরবে নারীর অধিকার আদায়ের বিষয়টি সামনে এসেছে। এখন আমরা যে নারী নিপীড়নের ঘটনাগুলো ঘটতে দেখছি সেই ঘটনাগুলো অনাকাক্সিক্ষত, অনভিপ্রেত। কিন্তু এসব দুর্ভাগ্যজনক এবং অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা পাদপ্রদীপে আসছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যমের মাধ্যমে আমরা বিষয়গুলো জানছি। আগে যেমন এই বিষয়গুলোকে মানুষ নিয়তি বলে মেনে নিতে যে একজন নারীর জন্মই হয়েছে নির্যাতিত হওয়ার জন্য, নির্যাতিত হওয়ার পর তিনি কোনো প্রতিবাদ করতে পারবেন না। কারণ নানা রকম লোকলজ্জার ভয়ে এ ধরনের প্রতিবাদ করলে তাকেই উল্টে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে, সেই বাস্তবতা থেকে নারীকে তার অধিকার আদায়ের জায়গায় সোচ্চার হওয়ার যে মন্ত্রণা, শক্তি সেটি কিন্তু ড. ইউনূসের দর্শন থেকেই আহরিত। সারা দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের যে বিস্তৃত কর্মযোগ্য, এই কর্মযোগ্যকে যদি আমরা আরও রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর মধ্যে আত্মস্থ করি এবং ড. ইউনূস আবিষ্কৃত গ্রামীণ ব্যাংকের যে চিন্তা এবং দর্শন সেটাকে যদি আমরা আমাদের রাষ্ট্র এবং সমাজে বাস্তবায়নের চেষ্টা করি তাহলে দেখব যে একটা অভূতপূর্ব নারী জাগরণ হবে। এর ফলে নারীর কর্মসংস্থান যেমন বৃদ্ধি পাবে, নারীশিক্ষার হার এবং নারী অধিকার প্রাপ্তির হারও বেড়ে যাবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে দেশের ৫১ শতাংশ জনগোষ্ঠী নারী। কাজেই এই বিরাট জনগোষ্ঠীকে বাইরে রেখে কোনোভাবেই একটি কাক্সিক্ষত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আর এ কারণেই নারীকে আমাদের উন্নয়নের মূল কাঠামোর মধ্যে সম্পৃক্ত করতে হবে। এই সম্পৃক্তটি যেন বৈষম্যমুক্ত হয় সেজন্য ড. ইউনূসের দর্শনের কোনো বিকল্প নেই। আজকে আছিয়ার মতো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাগুলো ঘটছে এটি শুধু আইন দিয়ে বন্ধ করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন সমাজের নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। সমাজে নারীর ন্যায্য অবস্থান নিশ্চিত করা। আর সেটি করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় পথ হলো শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যে নারী ক্ষমতায়ন দর্শন তা বাস্তবায়ন। এই দর্শনকে যদি আমরা সর্বস্তরে বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে নারী নিপীড়নমুক্ত একটি দেশ আমরা পেতেই পারি।

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩১ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০২৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ