মাদারীপুর: স্বপ্ন নিয়ে দালালচক্রের হাত ধরে ইতালির উদ্দেশে লিবিয়া পাড়ি জমায় মাদারীপুরের অসংখ্য যুবকেরা। ভাগ্য সহায় থাকায় অনেকেই ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি পৌঁছাতে পারলেও বড় একটি অংশ জিম্মি থাকে লিবিয়ায়।
নির্যাতনে মৃত্যু, ভূমধ্যসাগর পার হতে গিয়ে নৌকাডুবিতে মৃত্যুর মিছিল কমছে না। গত তিন মাসে মাদারীপুর জেলায় এরকম নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে ১৫ জন। এসব পরিবারে এবারের ঈদ এক বিষাদের ছায়া নিয়ে এসেছে। সন্তান হারানো বেদনায় ঈদ আনন্দ নেই লিবিয়ায় নিহত স্বজনদের পরিবারে। শুধু লাশের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছেন এসব পরিবার!
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে ২৩ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার ১০ যুবকের মৃত্যু হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি পরিবারগুলো নিশ্চিত হন সন্তানদের মৃত্যুর বিষয়টি। এরপর গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দালালদের নির্যাতনে সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের খাটোপাড়া গ্রামের শহিদুল বেপারীর ছেলে সাইদুল বেপারীর মৃত্যু হয়। ঘটনা ভিন্ন খাতে নিতে মরদেহ ট্রলারে করে অভিবাসীদের সঙ্গে ইতালি পাঠানো হয়। এদিকে দালালের নির্যাতনে গত ২২ ফেব্রুয়ারি সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের পখিরা গ্রামের নাজিম উদ্দিন মহাজনের ছেলে রাকিব মহাজনের মৃত্যু হয়।
গত ৯ মার্চ বিকেলে নৌকাডুবিতে মারা যান রাজৈর উপজেলার বদরপাশা এলাকার চরমস্তফাপুর গ্রামের আবু হাওলাদারের ছেলে সুমন হাওলাদার ও একই উপজেলার শাখারপাড়ের সিদ্দিক মাতুব্বরের ছেলে নাসির মাতুব্বর। এরপর মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয় জেলার শিবচর উপজেলার নিলখী ইউনিয়নের বাগমারা এলাকার চানমিয়া সরদারের ছেলে সজিব সরদার (২৮)। লিবিয়ায় দালালের নির্যাতনে নিহত সজিবের মৃত্যুর খবর পরিবারের কাছে পৌঁছায় গত ২০ মার্চ।
নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করলে তারা জানান, স্বপ্নের দেশ ইতালি যাওয়ার জন্য দালালদের মাধ্যমে লিবিয়া যায় এসব যুবকরা। তবে দেশ থেকে যাওয়ার সময় লিবিয়া থেকে সরাসরি 'গেম দিয়ে' ইতালি নেওয়ার কথা থাকে। তবে লিবিয়ায় পৌঁছানোর পরই চিত্র পাল্টে যায়। একাধিকবার দালালদের হাত বদল হয় (বিক্রি)। এরপর চলে নির্যাতন। সেই ছবি দেখিয়ে দেশ থেকে দফায় দফায় টাকা আদায় করে। কোনো কোনো পরিবার ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা খরচ করলেও তাদের সন্তানদের রক্ষা করতে পারেননি। দালালদের নির্যাতনে অবশেষে মারা গেছে তারা। এছাড়া ইতালি যাওয়ার সময় নৌকাডুবিতে মৃত্যু তো আছেই! এসব পরিবারে ঈদ বলতে কিছু নাই আর!
নৌকাডুবিতে নিহত রাজৈর উপজেলার গোবিন্দপুর এলাকার নিহত ইনসানের ভগ্নিপতি মনির হোসেন বলেন, ভাই ঈদ নাই এই পরিবারের। গত ২৪ জানুয়ারি ইনসানসহ রাজৈরের ১০ জন মারা গেছে নৌকা ডুবিতে। আমরা লাশ আনার জন্য আবেদন করেছি। এখন লাশের জন্য অপেক্ষা শুধু!
ওই এলাকার নিহত সুমন ও নাসির মাতুব্বরের পরিবার জানান, সন্তানদের জন্য ধার-দেনা, জমিজমা বিক্রি করে টাকা দিয়েছি। আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। শেষ দেখতে পারবো কিনা তাও জানা নাই!
সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের খাটোপাড়া নিহত সাইদুলের পরিবার জানান, দফায় দফায় ৬০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়েও সাইদুলকে বাঁচানো যায়নি। সন্তান হারিয়েছি, টাকা-পয়সা সব শেষ হয়ে এখন নিঃস্ব পরিবারটি।
জেলার শিবচর উপজেলার নিহত সজিব সরদারের বাবা চানমিয়া সরদার বলেন, দালাল ৪৬ লাখ টাকা নিছে। লিবিয়ায় নিয়ে ৪/৫ বার বিক্রি করে দেয় আমার ছেলেরে। শিকল দিয়া আটকাইয়া মারধর করতে করতে আমার ছেলেরে মাইরা ফালাইছে! আমাগো কোনো ঈদ নাই বাবা!'
স্বপ্নের দেশ ইতালি হাতছানি দেয় তরুণদের। আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতার আশায় জীবনের ঝুঁকি নেয় তরুণেরা। দালালচক্রের রঙিন প্রলোভন তরুণদের স্বপ্নকেও রঙিন করে তোলে। স্বপ্নের দেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে দিন দিন বাড়ছে মৃত্যু, নিখোঁজ ও বন্দি জীবন। একমাত্র সন্তানের জন্য জমি-জমা, ভিটে-মাটি বিক্রি পর্যন্তও করতে হচ্ছে। এরপর সন্তানও হারাতে হচ্ছে। দিন দিন নিঃস্ব হয়ে যাওয়া এসব পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে মাদারীপুর। ঈদ তাদের জীবনে খুশির সংবাদ নিয়ে আসছে না! সন্তান হারানোর বেদনা আর লাশ ফিরে পাবার আকুতি এখন বাবা-মায়ের সম্বল!
বাংলাদেশ সময়: ১৮০০ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০২৫
আরএ