ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩২, ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বিদেশে পালানো নসরুল হামিদ সম্পত্তি বেচতে খুঁজছেন ক্রেতা

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০২৫
বিদেশে পালানো নসরুল হামিদ সম্পত্তি বেচতে খুঁজছেন ক্রেতা

ঢাকা: রাজধানীর গুলশান ক্লাবের উল্টো পাশে এক বিঘার বড় একটি প্লট রয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের। অনেকটা বাগানবাড়ির আদলে জায়গাটি গড়ে তুলেছেন তিনি।

ক্ষমতায় থাকাবস্থায় পরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সেখানে আড্ডা দিতেন তিনি। সেসময় প্লটটি ছিল তার ‘সুখের রাজ্য’।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান নসরুল হামিদ। কিছুদিন কোনো খোঁজ-খবর না থাকলেও গত দুই মাস ধরে জায়গাটি বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজছেন তিনি। বর্তমানে তার এই জায়গার বাজারমূল্য ২০০ কোটি টাকা।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই প্লটটি বিক্রি করতে বড় বড় ব্যবসায়ীদের ধরছেন নসরুল হামিদ।

তবে এত বড় জায়গা মোটা অংকের টাকা দিয়ে কেনার মতো কোনো ক্রেতা না পাওয়ায় ছোট প্লট আকারে বিক্রির তৎপরতা চালাচ্ছে নসরুল হামিদের কোম্পানি হামিদ রিয়েল এস্টেট। শুধু এ জায়গাই নয়, রাজধানীর মাদানী এভিনিউর ১০০ ফুট রাস্তার পাশেও নসরুল হামিদের পাঁচ বিঘা জমি রয়েছে। এ জমিও বিক্রি জন্য ক্রেতা খুঁজছেন তিনি।

সূত্র জানায়, বড় আয়তনের এই দুইটি জায়গা এখন পর্যন্ত বিক্রি করতে না পারলেও গুলশান, বনানী ও নিকেতন এলাকার একাধিক ছোট প্লট ও বাড়ি এরই মধ্যে বিক্রি করে দিয়েছেন নসরুল হামিদ।

সম্পত্তি বিক্রির ওই টাকার বড় অংশই তিনি হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে নিয়ে গেছেন। বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন তিনি।  

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী বলেন, নসরুল হামিদ আমাকে বলেছেন, তার বেশির ভাগ সম্পত্তিই বিক্রি করে দেবেন। সেজন্য ক্রেতা খুঁজছেন তিনি। আমাকে অনুরোধ করেছেন যেন তার গুলশান ও মাদানী এভিনিউয়ের জায়গা কিনি।

এ ছাড়া তাকে যেন ক্রেতা খুঁজে দেই। তার জমি কেনার মতো আমার কাছে এত টাকা নেই। আমি অপারগতা প্রকাশ করেছি।

নসরুল হামিদের পৈতৃক ব্যবসা ছিল জমি বেচাকেনা তথা রিয়েল এস্টেটের। তাদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হামিদ গ্রুপ। এ গ্রুপের অধীনে হামিদ রিয়েল এস্টেট কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, হামিদ কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, ডেলকো বিজনেস অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড, হামিদ ইকোনমিক জোন, হামিদ ফ্যাশন লিমিটেড অ্যান্ড হামিদ সোয়েটার লিমিটেড ও হামিদ এগ্রো লিমিটেডের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। হামিদ গ্রুপের রিয়েল এস্টেট ব্যবসার ব্র্যান্ড হলো ‘প্রিয়প্রাঙ্গণ’। গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদে রয়েছেন নসরুল হামিদ বিপুর ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু। বিপুর মতো তিনিও বর্তমানে পলাতক।  

সম্পত্তি বিক্রির বিষয়ে বক্তব্য জানতে নসরুল হামিদ ও তার ভাই ইন্তেখাবুল হামিদের সঙ্গে একাধিক মাধ্যমে যোগাযোগ করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।  

হামিদ রিয়েল এস্টেট কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘নসরুল হামিদ বিপু ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের পরিমাণ অন্তত ৮ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত কোম্পানিগুলোর ব্যবসা সচল ছিল। কিন্তু এর পর থেকেই পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপ হয়েছে। বেশকিছু কর্মীকে এরই মধ্যে ছাঁটাই কিংবা ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। কোম্পানির রিয়েল এস্টেট ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। বেশকিছু জমি এরই মধ্যে বেদখল হয়ে গেছে। ’

হামিদ রিয়েল এস্টেট কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের আওতায় রাজধানীর কেরানীগঞ্জে প্রিয়প্রাঙ্গণ-১ ও প্রিয়প্রাঙ্গণ-২ আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আবাসিক এলাকাটিতে নগদ ও কিস্তিতে প্লট বিক্রি করছে হামিদ গ্রুপ। আবাসিক এলাকাটির প্রতিষ্ঠাকালীন জোরপূর্বক জমি কিনে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আবার বাজারমূল্যের চেয়ে কমেও জমি বিক্রিতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন কেউ কেউ।

গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর তার এমপি-মন্ত্রীরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। তাদের বেশিরভাগ ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে কেউ কেউ সম্পত্তি বিক্রি করে সেই টাকা দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে নিয়ে গেছেন।  

নসরুল হামিদ ২০১৪ সাল থেকে এক দশকের বেশি সময় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। বিগত দেড় দশকে সরকারের সবচেয়ে বেশি অর্থের অপচয় ও লুটপাট হয়েছে এ মন্ত্রণালয় ঘিরে। নিজের ব্যবসা ও ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থে নসরুল হামিদ বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজধানীর বাইরে দেশের বিভিন্ন স্থানেও তার সম্পত্তি ও ব্যবসা রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দেড় দশকে দেশের বিদ্যুৎ খাতে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ হয়। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী (প্রতি ডলার ১২২ টাকা দরে) এ বিনিয়োগের পরিমাণ ৩ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল ২০০৯-১০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত এক যুগে বিদ্যুৎ খাতে ২৮ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার (৩ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা) বিনিয়োগ হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের এ তথ্য নসরুল হামিদ নিজেই ২০২২ সালে জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন।

দেশে গত দেড় দশকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে গণহারে কয়েক ডজন প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এসব প্রকল্প দেওয়া হয়েছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষ আইনের অধীনে। এ আইনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই দরকষাকষির মাধ্যমে প্রকল্প অনুমোদনের সুযোগ রাখা হয়েছিল। শেখ হাসিনা নিজেই এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকায় নসরুল হামিদ একাই পুরো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সর্বেসর্বা ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আইনের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই তিনি বিভিন্ন প্রকল্প ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিতেন।

বিদ্যুৎ খাতের একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, গত এক দশকে দেশে যতগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন পেয়েছে, তার প্রত্যেকটির বিনিময়ে নসরুল হামিদকে শতাংশের হিসাবে ঘুষ দিতে হয়েছে। এ খাত থেকে তার প্রাপ্ত ঘুষের পরিমাণই হবে হাজার কোটি টাকার বেশি।

বিদ্যুৎ খাতের পাশাপাশি এলপিজি ও এলএনজি আমদানিতেও বিভিন্নভাবে ভাগ বসিয়েছিলেন নসরুল হামিদ। ২০২১ সালে দেশে এলপিজি আমদানিতে বৃহৎ একটি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল সরকার। বিপুল বিনিয়োগের এ প্রকল্পটি বাগিয়ে নিতে সিঙ্গাপুরে নিজের মামার নামে নসরুল হামিদ একটি শেল কোম্পানি খুলেছিলেন। ওই কোম্পানিসহ আরও দুই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ভিটল ও জাপানের মারুবেনি করপোরেশনকে ৩০৫ মিলিয়ন ডলারের এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণে চুক্তির জন্য নির্বাচিত করতে হস্তক্ষেপ করেছিলেন তিনি। গুরুতর এ দুর্নীতির বিষয়টি ওই সময় প্রকাশ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত নসরুল হামিদকে পিছিয়ে আসতে হয়।

অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ৯৮টি ব্যাংক হিসাবে ৩ হাজার ১৮১ কোটি টাকা অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগে এরই মধ্যে নসরুল হামিদ বিপুর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিপু ছাড়াও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার স্ত্রী সীমা হামিদ ও ছেলে জারিফ হামিদের নামেও পৃথক মামলা করেছে সংস্থাটি। গত ডিসেম্বরে দায়েরকৃত এসব মামলায় তাকেও আসামি করা হয়েছে।

নসরুল হামিদের বিরুদ্ধে গত বছরের ২২ আগস্ট দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুদক। ওইদিন তার প্রতিষ্ঠান হামিদ গ্রুপে অভিযান চালায় যৌথবাহিনী। এ সময় ‘প্রিয়প্রাঙ্গণ’ নামে ভবনের ভেতর থেকে বেশ কয়েকটি ভল্টে থাকা নগদ অর্থ, বৈদেশিক মুদ্রা এবং অস্ত্র-গুলিসহ অন্যান্য সামগ্রী জব্দ করা হয়।

সূত্র: বণিক বার্তা

বাংলাদেশ সময়: ১২১০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০২৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।