ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার শুরু হয়ে গেছে। পুরোপুরি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচার হবে।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্য সফরকালে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সাক্ষাৎকারে তিনি দেশের রাজনীতি, সংস্কার, নির্বাচন ও রোহিঙ্গা সমস্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন।
সাংবাদিক রাজিনি বৈদ্যনাথনের নেওয়া এ সাক্ষাৎকার শনিবার (২১ জুন) বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে।
প্রশ্ন: আপনার দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলি। আপনি নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। আপনি দেশটির অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতা। আপনি বলেছেন, এই নির্বাচন যেন অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক হয়। কিন্তু একটা সমালোচনা হচ্ছে যে, আপনি আওয়ামী লীগকে, অর্থাৎ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে দিচ্ছেন না। কেন?
অধ্যাপক ইউনূস: আমরা বহুবার এটা ব্যাখ্যা করেছি, আবারও বলছি। প্রথমত, আওয়ামী লীগ না থাকলেও নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে কি না; সম্প্রতি ঢাকায় জাতিসংঘের রেসিডেন্ট কো-অর্ডিনেটর খুব ভালোভাবে এটা ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক মানে কোনো নির্দিষ্ট দল নয়, সব মানুষের অংশগ্রহণ। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ ভোট দিতে পারছে, ততক্ষণ এটা অন্তর্ভুক্তিমূলক।
প্রশ্ন: দেশের অনেক মানুষ এখনো আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে।
অধ্যাপক ইউনূস: তাদের সিদ্ধান্ত নিতে দিন তারা ভোট দিতে চায় কি না…
প্রশ্ন: তারা আওয়ামী লীগকে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে না।
অধ্যাপক ইউনূস: যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ভোটার—তাদের ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা আছে।
প্রশ্ন: কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে নয়, যদি না আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়।
অধ্যাপক ইউনূস: আমরা এখনো আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করিনি।
প্রশ্ন: তাহলে আপনি বলছেন, তারা আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে...
অধ্যাপক ইউনূস: না, আগে একটা বিষয় পরিষ্কার করি—আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। তাদের কার্যক্রম সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যার মধ্যে নির্বাচনও পড়ে। এটা সাময়িক। নির্বাচনে তারা থাকবে কি না, সেটা নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।
প্রশ্ন: তাহলে আগামী নির্বাচনের ব্যালটে তাদের থাকার সম্ভাবনা আছে?
অধ্যাপক ইউনূস: আবারও বলছি, এটা নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের বিষয়।
প্রশ্ন: আচ্ছা, যেহেতু আমরা আওয়ামী লীগ নিয়ে কথা বলছি, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। আপনি দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি এখন ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তো আপনি তাকে ফেরত আনতে চান, তাই না? তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আছে, তা নিয়ে আপনি তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে চান?
অধ্যাপক ইউনূস: বিচার ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে, এটা চলমান একটা প্রক্রিয়া। পুরোপুরি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচার হবে। আমরা চাই তিনি বিচারের মুখোমুখি হোন। তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য আন্তর্জাতিক পদ্ধতি ব্যবহার করব—যেভাবে একজন অভিযুক্তকে দেশে ফিরিয়ে আনা যায়, সেটাই করব। এটা সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়া।
প্রশ্ন: কীভাবে তাকে ফিরিয়ে আনবেন? মানে, আপনার তো নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে অনেক দেখা হয়।
অধ্যাপক ইউনূস: আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ব্যবহার করে। তাকে ধরে আনার কোনো ক্ষমতা তো আমাদের নেই।
প্রশ্ন: কিন্তু আপনি যেসব অভিযোগ করেছেন, শুধু শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নয়, তার সহযোগীদের বিরুদ্ধেও, যাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ, দুর্নীতিসহ আরও অনেক অভিযোগ আছে — এসব সত্ত্বেও তিনি তাকে এতদিন থাকতে দেওয়ায় আপনি কি মোদির ওপর বিরক্ত নন?
অধ্যাপক ইউনূস: তার ভারতে থাকা বাংলাদেশিদের জন্য তেমন কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে তার কণ্ঠস্বর, তিনি নিয়মিত বাংলাদেশের মানুষের উদ্দেশে ভাষণ দেন, মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার করেন।
প্রশ্ন: তাহলে আপনি মনে করেন ভারতকে আরও কিছু করা উচিত, যেন তিনি এই ভাষণগুলো না দিতে পারেন?
অধ্যাপক ইউনূস: সেটা আপনি বলছেন।
প্রশ্ন: অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের শত শত সমর্থক বা সহানুভূতিশীলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, আপনি কি তাহলে ঠিক তাদের মতোই সমালোচকদের দমন করছেন?
অধ্যাপক ইউনূস: এটা বলা লজ্জাজনক হবে। আপনি যদি অন্তর্বর্তী সরকারকে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে তুলনা করেন, তাহলে বুঝতে হবে আপনি বাংলাদেশকে বোঝেন না, বাংলাদেশের বাস্তবতাকে বোঝেন না। আপনি বোঝেন না আওয়ামী লীগ কী, আর অন্তর্বর্তী সরকার কী।
প্রশ্ন: এগুলো আমার কথা নয়, অনেকে বলছে।
অধ্যাপক ইউনূস: ঠিক আছে, কেউ বলেছে, কিন্তু আপনি তো বাংলাদেশে এসেছেন। তাই আমি বলছি এটা একদম ঠিক নয়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরই দায়িত্ব রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান করা
প্রশ্ন: রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের বিষয়টি বিশ্ব অনেকটাই ভুলে গেছে। আমি কক্সবাজারের ক্যাম্পে গিয়েছি, নিজের চোখে দেখেছি তাদের কোনো স্বাধীনতা নেই। তারা খাবারের জন্য লড়াই করছে, অনবরত খাদ্য সহায়তা কমানো হচ্ছে, আর শিশুদের জন্য ভালো মানের শিক্ষাব্যবস্থা নেই। এটা আপনার দোরগোড়ায় থাকা একটি সংকট — আপনি তাদের সাহায্যের জন্যে কেন আরও বেশি কিছু করছেন না?
অধ্যাপক ইউনূস: আমরা? আমরা নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। এটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব।
প্রশ্ন: কিন্তু এটা তো বাংলাদেশে ঘটছে, আর আপনি তো একজন নোবেলবিজয়ী — সবসময় দুর্বলদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলেছেন।
অধ্যাপক ইউনূস: অবশ্যই।
প্রশ্ন: তাই প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি আরও বেশি কিছু কেন করছেন না?
অধ্যাপক ইউনূস: আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আমি জাতিসংঘের মহাসচিবের সাথে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে এক লাখের বেশি রোহিঙ্গার সাথে দেখা করেছি, কী করা উচিত সে বিষয়ে আলোচনা করেছি, এবং এদের ফেরার জন্যে সহায়তা চেয়ে বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। সেক্ষেত্রে প্রত্যাবাসনই একমাত্র সমাধান। সবাই এখন শুধু খাবার ও অন্যান্য সহায়তা নিয়েই ব্যস্ত, কিন্তু এদের নিজ দেশে কীভাবে ফেরত পাঠানো যাবে, সে বিষয়ে কেউ আলাপ করছে না।
প্রশ্ন: কিন্তু প্রফেসর ইউনূস বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটাও তো বাস্তবসম্মত নয়। আমি রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলেছি, তারা জানিয়ে দিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের কারণে তারা ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছে। তাহলে আপনারা কেন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে একীভূত করার চেষ্টা করছেন না?
অধ্যাপক ইউনূস: সেটা কোনো সমাধান হবে না।
প্রশ্ন: কেন হবে না?
অধ্যাপক ইউনূস: ক্যাম্পের আশপাশে থাকা মানুষ রোহিঙ্গাদের প্রতি বিরূপ। কারণ তারা দেখছে আন্তর্জাতিক সাহায্য কেবল রোহিঙ্গাদের জন্য আসছে, আর রোহিঙ্গারা যেন সহজেই বেঁচে আছে, যেখানে বাইরের লোকদের কঠোর পরিশ্রম করতে হচ্ছে।
প্রশ্ন: কিন্তু আপনি তো নিজের চোখে দেখেছেন পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ।
অধ্যাপক ইউনূস: বাংলাদেশের নীতিই হলো, তাদের ক্যাম্পের বাইরে স্থায়ী হতে না দেওয়া। আমাদের নিজেদেরই অনেক সমস্যা আছে। আমরা নতুন আরেকটা জনগোষ্ঠীর বোঝা বইতে পারবো না।
প্রশ্ন: তারা কষ্ট করা সত্ত্বেও?
অধ্যাপক ইউনূস: হ্যাঁ, সে কারণেই আমরা তাদের জায়গা দিয়েছি। আমরা তো বলিনি যে তোমরা আসতে পারবে না। আমরা তো সীমান্ত আটকে দেইনি। আমরা তাদের গ্রহণ করেছি। তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আশ্বাস দিয়েছিল, তারা দেখভাল করবে, তারা তাদের নিজেদের দেশে নেবে। এমনকি কোন দেশ কতজন নেবে, সেই সংখ্যাও ভাগ করা হয়েছিল।
এইচএ/