ঢাকা, শুক্রবার, ২ শ্রাবণ ১৪৩২, ১৮ জুলাই ২০২৫, ২২ মহররম ১৪৪৭

জাতীয়

জুলাই গাথা

ছেলেকে নিয়ে আন্দোলনে যেতে চাওয়া ময়নুল ফেরেন শহীদ হয়ে

নাসির উদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:৪৫, জুলাই ১৭, ২০২৫
ছেলেকে নিয়ে আন্দোলনে যেতে চাওয়া ময়নুল ফেরেন শহীদ হয়ে শহীদ ময়নুলের ছবি হাতে পরিবার

একজন বাবা— যিনি চেয়েছিলেন ছেলেকে নিয়ে দেশের জন্য কিছু করতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। ছেলেকে বলেছিলেন, ‘চল বাপ বেটা একসাথে আন্দোলনে যাই, দেশের জন্য একসাথে শহীদ হই।

’ কিন্তু ফিরলেন একা, নিথর দেহ হয়ে। সেই বাবার নাম ময়নুল ইসলাম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিজের বুক পেতে দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন, এই জাতির সবচেয়ে সাহসীরা অনেক সময় শহরের রাজনীতিক নয়, মফস্বলের এক নিঃস্ব দোকানদারও হতে পারেন।

ময়নুল ইসলাম ছিলেন সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার মোল্লাপাড়ার সন্তান। বসবাস করতেন বিয়ানীবাজার উপজেলার নয়াগ্রামে। পেশায় ছিলেন একজন ফল ব্যবসায়ী। বাজারে ফল, পান-সুপারির ছোট্ট দোকান চালিয়ে সংসার চালাতেন। স্ত্রী শিরিন বেগম, মেয়ে ফাতিমা ৭ম শ্রেণির ছাত্রী, ছেলে শিহাব পড়ে ফাইভে। এই ছিল তার ছোট্ট জগৎ।

ময়নুলের স্বপ্ন ছিল ফাতিমাকে একদিন ডাক্তার বানিয়ে গ্রামের গরিব মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করাবেন। আর ছেলে শিহাব বড় হয়ে হবেন এক আলেম, দ্বীনের খেদমতে নিবেদিত। সংসারে তার তেমন চাহিদা ছিল না, কিন্তু সন্তানদের নিয়ে স্বপ্ন ছিল অনেক বড়।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। বিয়ানীবাজারের পিএইচজি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলছিল। ময়নুল ইসলাম ছেলেকে নিয়ে আন্দোলনে যেতে চেয়েছিলেন। ছেলেকে বলেছিলেন, চল বাপ বেটা মিলে আন্দোলনে যাই। ছেলে শিহাব প্রথমে রাজি হলেও পরে ফিরে আসে। কিন্তু ময়নুল যান একা। আর সেখানেই ঘটে সেই মর্মান্তিক ঘটনা।

বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন ময়নুল ইসলাম। আহত অবস্থায় প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে ইবনে সিনা হাসপাতাল ও পরবর্তীতে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে রাত ১০টার দিকে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ৬ আগস্ট, বিয়ানীবাজার পৌর কবরস্থানে নিজের বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয় শহীদ ময়নুল ইসলামকে।

ঘটনার দিনটির কথা আজও ভুলতে পারে না তার মেয়ে ফাতিমা। সে বলে, আমার আব্বু বাসায় ছিলেন। দুপুরে আনারস বাগান থেকে এসে শিহাবকে বলেন আসো আন্দোলনে যাই। পরক্ষণে শিহাব রাস্তা থেকে ফিরে আসে, আর তিনি একাই যান ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিতে। বিকেলে মামাতো ভাই ফোন দিয়ে বলে, ফুফা গুলি খাইছেন। তখন আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। হাউমাউ করে কেঁদে আমার মা, ভাইসহ বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাই। তখন আব্বুকে দেখে মা জ্ঞান হারান। আমরা আব্বুকে রক্তাক্ত অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে সিলেট শহরে ইবনে সিনা হাসপাতালে যাই। সেখানে যাওয়ার পর রাত ১০টার দিকে বাবা মারা যান। বাবা নেই, এখন মা সব কিছু করেন। খুব কষ্ট করে কাজ করে আমাদের খাবার যোগান দেন।

শহীদ ময়নুলের মেয়ে ফাতিমা

বাবার হত্যাকারীদের বিচার চেয়ে ফাতিমা বলে, এতো শহীদ পরিবার। সরকার শুধু বলে যাচ্ছে বিচার হবে, কবে হবে? তাছাড়া অনেকে বাবাসহ শহীদদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করে, ওরা নাকি এমনি মরছে, কারও জন্য মরেনি। আরও বলে, আওয়ামী লীগ নাকি ফিরে আসবে! অনেক কিছু শুনি। তাদের কি বিচার হবে না? এতো শহীদ পরিবার, কেউই দেখিনি, কারও বিচার হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, আমরা যেন বিচার পাই। সরকার যেন হত্যার বিচারটুকু করে।

শিহাব বলে, ওইদিন আব্বু আমারে বলেছিল, চল বাপ বেটা একসঙ্গে আন্দোলনে যাই। দেশের জন্য একসঙ্গে শহীদ হই। আমি আব্বুর সঙ্গে গিয়েছিলামও। পরে অর্ধেক পথ থেকে ফিরে আসি। কিন্তু আমার আব্বু আর ফিরে আসেননি।

এখন অন্যের টিনের ছাপড়া ঘরে আশ্রয়ে দিন কাটে তাদের। শোক আর অস্থিরতায় কেটে যায় রাতগুলো। ফাতিমা আর শিহাবের জীবনে বাবার শূন্যতা আরেক ভয়াবহ যুদ্ধের নাম— অভাব, অনিশ্চয়তা, বিচারহীনতা। মা শিরিন বেগম এখন একাই যুদ্ধ করছেন এই সংসার, স্বপ্ন আর শোক নিয়ে।

শহীদ ময়নুলের স্ত্রী শিরিন বেগম

তিনি বলেন, সবাই তো আর প্রতিদিন আমাদের সাহায্য করবে না। জুলাই ফাউন্ডেশন ও সরকারি তরফ থেকে কিছু আর্থিক সহযোগিতা পেল সবাই। সব সময়তো আর খবর নিবে না। নিজেদের বাড়ি না তাকায় অন্যের বাড়িতে ভাড়া থাকি। সরকার যদি আমার এতিম ছেলে-মেয়েদের একটু মাথাগোঁজার ঠাঁই করে দিতেন। সন্তানদের পড়ালেখা চালিয়ে কোনোভাবে দিন পার করলেই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আমিও আর কয়দিন বাঁচবো। সন্তানদের যদি ভালো কোনো ব্যবস্থা হয়েছে দেখে যেতে পারি, তবেই শান্তিতে মরতে পারবো।

সরেজমিন দেখা গেছে, দেশের জন্য প্রাণ দিলেও শহীদ ময়নুল ইসলামের পরিবার আজও আশ্রিত জীবন যাপন করছে। দুই সন্তান নিয়ে স্ত্রী শিরিন অন্যের জায়গায় বসবাস করছেন।

তিনি বলেন, আমার স্বামী দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন। আমার বাড়ি নাই, সন্তানদের নিয়ে অন্যের বাড়িতে আছি। এ যাবৎ সরকারি বেসরকারি সহযোগিতা হিসেবে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা, ইউএনও ১০ লাখ টাকার একটি সঞ্চয়পত্র করে দিয়েছেন। এখন চাওয়া বলতে, একবছর হয় হত্যার ঘটনায় মামলা দায়ের করেছি। কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখি না। পুলিশও কিছুই বলে না। অন্তত প্রকৃত অপরাধী যারা, তাদের বিচারের মুখোমুখি করে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।

এনইউ/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।