ঢাকা, শুক্রবার, ৬ ভাদ্র ১৪৩২, ২২ আগস্ট ২০২৫, ২৭ সফর ১৪৪৭

জাতীয়

আজিজ খান-ফারুক খান ভাইবেরাদারের অর্থ পাচার

বিদ্যুৎ খাতে মাফিয়া লুটেরা

সৌজনে: বাংলাদেশ প্রতিদিন |
আপডেট: ০৮:১২, আগস্ট ২১, ২০২৫
বিদ্যুৎ খাতে মাফিয়া লুটেরা

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত এখন ‘সামিট গ্রুপ’নির্ভর। বিদ্যুতের জন্য দেশের মানুষ সামিট গ্রুপের কাছে রীতিমতো জিম্মি।

দেশের বিদ্যুৎ খাত পরনির্ভরশীল এবং ঝুঁকিতে ফেলেছিল স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার। মূলত একটি প্রতিষ্ঠানকে বিদ্যুৎ খাতে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব দিতেই দেশ ঝুঁকিতে ফেলে পতিত সরকার। সামিট গ্রুপ দেশ জিম্মি করে বিদ্যুৎ খাতে চালায় অবাধ লুণ্ঠন।

আওয়ামী স্বৈরশাসন আমলে নিজেরাই শুধু বিদ্যুৎ খাতে লুট করেনি, এ খাত ঘিরে গড়ে তুলেছে দুর্নীতিবাজ চক্র। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন হওয়ায় অঘোষিতভাবে বিদ্যুৎ খাতের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে যায় সামিট গ্রুপ। কে কুইক রেন্টাল পাবে, কার কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে হবে এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত সামিট গ্রুপ। বিদ্যুৎ খাতে প্রতিমন্ত্রী, সচিব এঁদের কাজ ছিল কেবল দুর্নীতি করা, কমিশনের টাকা তোলা আর বিদেশে লুটের টাকা পাচার করা। বিদ্যুতের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিত সামিট গ্রুপ।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে দেখা যায়, সামিট গ্রুপের কর্ণধার আজিজ খান এবং তাঁর কন্যা আয়েশা আজিজ খান শেখ হাসিনা এবং তাঁর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আজিজ খান কোনো মন্ত্রী-এমপি না হলেও দেশে এলে ভিভিআইপি প্রটোকল পেতেন। আজিজ খান এবং আয়েশা আজিজ খান শেখ হাসিনার সঙ্গে কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই দেখা করতেন। এ সময় সজীব ওয়াজেদ জয় ঘন ঘন সিঙ্গাপুর যেতেন। সেখানে তিনি আজিজ খানের বাসায় থাকতেন। এ ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে অবাধে লুটপাট করে সামিট গ্রুপ।

দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি পুঁজি করে দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বিশেষ বিধান পাস করা হয় ২০১০ সালে। এ আইনে টেন্ডার ছাড়াই প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর দেশের ভবিষ্যৎ বিদ্যুৎ চাহিদার অবাস্তব প্রাক্কলন করে একের পর এক ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রয়োজন না থাকলেও অনেক প্রকল্প দেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাকসহ প্রায় দুই ডজন সংসদ সদস্য সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ নানান প্রকল্পের কাজ পান। সামিট, ইউনাইটেড পাওয়ার, বাংলাক্যাট, মোহাম্মদী গ্রুপ, ডরিন, বারাক, সিনহাসহ বেশ কিছু কোম্পানি একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে। যদিও এত বেশি কেন্দ্রের প্রয়োজন ছিল না বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। ফলে অনেক কেন্দ্রই নামমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন করে শত শত কোটি টাকা আয় করে। সামিট গ্রুপের ব্যবসা মূলত বাংলাদেশকেন্দ্রিক হলেও গ্রুপটির বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর হোল্ডিং কোম্পানি ‘সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল’ নিবন্ধিত হয়েছে সিঙ্গাপুরে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির আয়ের বড় অংশই দেশের কাজে আসেনি এবং এ বিদেশি নিবন্ধন থাকার কারণে টাকা পাচারের সুযোগও পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সামিট গ্রুপের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল ক্রেতা প্রধানত সরকার। ফলে সরাসরি ভোক্তা পর্যায়ে কোনো দায় তাদের ছিল না। কেবল সরকারকে খুশি করেই ব্যবসা বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে এসব প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা দিতে গিয়ে দেশের বিদ্যুৎ খাতের একক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান বিপিডিবি এখন আর্থিক সংকটে সামিটের মতো বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর (আইপিপি) পাওনা পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। দেশি বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মোট স্থাপিত সক্ষমতার প্রায় ২১ শতাংশই সামিটের। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা রয়েছে ২০টি; যার সক্ষমতা প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট। দেখা গেছে, চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও এসব কেন্দ্র বানানোর অনুমতি দিয়েছে সরকার। ফলে গত ১৫ বছর বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত কেবল সামিট গ্রুপকে ৪ হাজার ৪০৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে পরিশোধ করা হয়েছে, যা এ সময়ের মধ্যে পরিশোধিত মোট ক্যাপাসিটি চার্জের প্রায় ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সামিট গ্রুপ শুধু বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতেই ৩৬ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করেছে।

দেশে গ্যাসসংকট থাকলেও সামিট গ্রুপকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়। সর্বশেষ দেশে গ্যাসসংকটের মধ্যে গত বছর নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে সামিটকে প্রায় ৬০০ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয় এবং এ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের জন্য কুমিল্লা থেকে মেঘনাঘাট পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। আইন অনুযায়ী সব ধরনের জ্বালানি তেল আমদানির একক এখতিয়ার বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কমিশনের (বিপিসি)। সেই বিপিসিকে দমাতে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে সামিট গ্রুপকে বছরে ১ লাখ টন ফার্নেস অয়েল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয় সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে। দেওয়া হয় ট্যাক্স অব্যাহতি। শুধু তাই নয়, উল্টো সরকারই ৯ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দেয় সামিট পাওয়ারকে। সামিট গ্রুপকে তেল আমদানির অনুমতি দেওয়ায় জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা আপত্তি তুলে বলেছিলেন, এতে ওভার ইনভয়েস করে টাকা পাচার করার সুযোগ তৈরি হবে, হয়েছেও তাই। একাধিক দফায় সামিটের তেল আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিংয়ের তথ্য পায় বিপিসি ও কাস্টমস। যদিও পরে সামিটের চাপে সবকিছু হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। দেখা গেছে, একই সময়ে বিপিসি যে দামে ফার্নেস অয়েল কিনেছে তার থেকে দেড় গুণ দামে আমদানি দেখিয়ে টাকা পাচার করে কোম্পানিটি। এ ছাড়া আমদানি করা এলএনজি সংরক্ষণ এবং রিগ্যাসিফিকেশনের জন্য দরপত্র ছাড়াই দায়মুক্তি আইনে মহেশখালীতে নির্মাণ করা হয়েছে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল (এফএসআরইউ)। এর একটি টার্মিনালের কাজ পায় সামিট।

চুক্তি অনুযায়ী, এফএসআরইউ অচল বা বন্ধ থাকলেও প্রতি মাসে সামিটকে ৪৫ লাখ ডলার (প্রায় ৯০ কোটি টাকা) ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সামিট গ্রুপের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সামিট গ্রুপের ১৯১টি ব্যাংক হিসাবে থাকা প্রায় ৪২ কোটি টাকা ফ্রিজের (অবরুদ্ধ) আদেশ দিয়েছেন আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেওয়া হয়। গত ৯ মার্চ ঢাকার মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ দুদকের আবেদন মঞ্জুর করে এসব ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের আদেশ দেন। দুদকের পক্ষে সংস্থাটির উপপরিচালক মো. আলমগীর হোসেন আলোচিত এই ব্যবসায়ী গ্রুপসংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ চেয়ে আবেদন করেন।

আবেদনে বলা হয়, অভিযোগসংশ্লিষ্ট সামিট গ্রুপ এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগসহ ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানকালে তাদের নামে সঞ্চয়ী, এফডিআর ও অন্যান্য হিসাবের তথ্য পাওয়া যায়। এসব হিসাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা রয়েছে। হিসাবগুলোয় বর্ণিত পরিমাণ অর্থ থাকার বিষয়টি অস্বাভাবিক ও সন্দেহমূলক। যে কোনো সময় বর্ণিত অর্থ উত্তোলনপূর্বক বিদেশে পাচার/গোপন করার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে মর্মে অনুসন্ধানকালে প্রতীয়মান হয়।

দুদক ১৯১টি হিসাবে মোট ৪১ কোটি ৭৪ লাখ ৭৬০ টাকা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ১৪ ধারা অনুযায়ী অবরুদ্ধ করা প্রয়োজন বলে আবেদনে করে। দুদকের আবেদেনের পরিপ্রেক্ষিতে এসব অর্থ অবরুদ্ধ করেছেন আদালত। অন্যদিকে সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান ও তাঁর পরিবারের নামে থাকা লুক্সেমবার্গে কোম্পানির শেয়ার অবরুদ্ধের আদেশ দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৪ মে ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন গালিব এ আদেশ দেন।

বিনিয়োগকৃত সম্পদের মূল্য ৪১ লাখ ১৫ হাজার ৪১২ ইউরো। বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫৬ কোটি ৬৫ লাখ ৬৮ হাজার টাকা।

দুদকের আবেদনে বলা হয়, সামিট গ্রুপ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি এবং অপরাধমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের তদন্ত চলছে। অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, লুক্সেমবার্গে সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান এবং তাঁর সহযোগীদের নামে এ সম্পদ পাওয়া গেছে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাঁদের এ সম্পদ অবরুদ্ধ করা আবশ্যক। আদালত আবেদন মঞ্জুর করে আদেশ দেন।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।