খুলনা: প্রয়াত সাংবাদিক মানিক সাহা হত্যা মামলার বিচারকাজ ১১ বছরেও শেষ হয়নি। দীর্ঘ সময়ে হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন না হওয়ায় ন্যায় বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন নিহতের পরিবারের সদস্যরা।
খুলনা প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মানিক সাহা মৃত্যুর আগে বিবিসি, দৈনিক সংবাদ, একুশে টেলিভিশন এবং নিউএজ পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন। সাংবাদিকতার পেশাকে উপাসকের ব্রতীতে পালন করে যাওয়া সংশপ্তকের নাম মানিক সাহা।
স্বাধীন, সাহসী, নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিক ছিলেন মানিক সাহা। রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতায় তিনি ছিলেন অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার, সাহসী এক কলমযোদ্ধা।
বৃহস্পতিবার (১৫ জানুয়ারি) নির্ভীক সাংবাদিক মানিক সাহার ১১ম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি খুলনা প্রেসক্লাবের কাছেই সন্ত্রাসীদের বোমার আঘাতে তিনি নিহত হন।
এ সময় শহীদ হাদিস পার্কে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের মহানগর কমিটির সম্মেলন থেকে প্রেসক্লাবে আসছিলেন মানিক সাহা। প্রেসক্লাবের সামনের কক্ষেই বসতেন তিনি।
কিছুক্ষণ পর তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন এক আগন্তুক। বেশ কিছুক্ষণ তাদের মধ্যে কথা হয়। আগন্তুক বিদায় নিলে তিনিও রিকশাযোগে বেরিয়ে পড়েন।
রিকশা চলতে শুরু করে আহসান আহমেদ রোডে তার বাসার দিকে। ছোট মির্জাপুরের দিকের রাস্তায় তাকে বহনকারী রিকশাটি পৌঁছালে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে।
পরক্ষণেই দেখা যায়, মানিক সাহার নিথর দেহটি রাস্তার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। মাথাটি যেন শরীর থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। মনে হচ্ছে, কেউ যেন মাথাটি কিছু একটা দিয়ে থেঁতলে গুঁড়ো করে দিয়েছে। আর এভাবেই সেদিন চিরতরে থেমে যান সাংবাদিক মানিক সাহা।
এরপর একেক করে পেরিয়ে গেছে ১১টি বছর। কিন্তু খুলনার সাহসী ও স্পষ্টবাদী এই সাংবাদিক হত্যার বিচার আজও হয়নি! ঘাতকরা পায়নি শাস্তি।
এই দীর্ঘ সময়ে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ না হওয়ায় ন্যায়বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন নিহত সাংবাদিক মানিক সাহার স্ত্রী নন্দা সাহা, মেয়ে নাতাশা ও পর্শিয়া। সেই সঙ্গে আশা ছেড়ে দিয়েছেন খুলনার স্থানীয় সাংবাদিকেরাও।
সাংবাদিক মানিক সাহা হত্যাকাণ্ডের পর সেদিন রাতেই খুলনা থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) রণজিৎ কুমার পাল বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয়দের আসামি করে দু’টি মামলা দায়ের করেন।
ওই মামলা দু’টির (হত্যা ও বিস্ফোরক) তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর ১৩ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করা হয়।
পরবর্তীতে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আরো তদন্তের নির্দেশ দিলে তদন্ত শেষে আরো একজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে সম্পূরক চার্জশিট দেওয়া হয়।
আসামিদের মধ্যে তিনজন ক্রসফায়ারে নিহত হন। নিহতরা হলেন- আব্দুর রশিদ, আলতাফ ওরফে বিডিআর আলতাফ এবং মাহফুজ ওরফে মফিজ ওরফে নাসিম ওরফে শফিকুল ইসলাম।
এছাড়া চারজন জেলহাজতে রয়েছেন। তারা হলেন, সুমন ওরফে নূরুজ্জামান, আকরাম হোসেন, আলী আকবর শিকদার, মো. হাই ইসলাম ওরফে কচি। পলাতক রয়েছেন বেলাল, সাত্তার, ওমর ফারুক, সরোয়ার হোসেন ওরফে সাকা ও মিঠুন।
মামলাটি খুলনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন ছিল। পরবর্তীতে মামলাটি মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। এর আগে কয়েক দফা মামলার বিচারক পরিবর্তন হয়েছে। আগামী ২৭ জানুয়ারি হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা দু’টির সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য রয়েছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণের কাজ চলছে। এ পর্যন্ত ৪৫ থেকে ৪৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। বার বার সমন দেয়ার পরও সাক্ষীরা আসতে চান না। একই অবস্থা বিস্ফোরক অংশের।
খুলনা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সুবীর কুমার রায় বুধবার (১৪ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় বাংলানিউজকে বলেন, একুশে পদকপ্রাপ্ত নির্ভীক সাংবাদিক মানিক সাহার হত্যার ১১ বছর পরও আমরা বিচার না পেয়ে হতাশ। ২০০৪ সালের পর থেকে প্রতি বছর ১৫ জানুয়ারি কেবল ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় তার প্রতি। শ্রদ্ধা জানাতে আসা সবাই ফিরে যান প্রকৃত হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে না পারার গ্লানি মাথায় নিয়ে। জানিনা এই গ্লানি আমাদের আর কত বছর বহন করতে হবে।
জঘন্যতম এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর সেই সময়ের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী খুলনায় ছুটে এসেছিলেন। বলেছিলেন, প্রকৃত হত্যাকারীরা চিহ্নিত হবে, সাজা পাবে।
কিন্তু গত ১১ বছরেও হত্যাকাণ্ডটির বিচার কাজ শেষ হয়নি। প্রকৃত হত্যাকারী চিহ্নিত না হওয়ায় এবং খুনিরা সাজা না পাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন খুলনা প্রেস ক্লাবের সভাপতি মকবুল হোসেন মিন্টু।
তিনি বুধবার (১৪ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় বাংলানিউজকে বলেন, নানা কারণে আমরা সাংবাদিকরা ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত। যার কারণে হত্যাকান্ডের ১১ বছর পার হলেও সাংবাদিক মানিক সাহার ঘাতকরা শান্তি পাচ্ছে না।
খুলনার চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার না হওয়ার উদাহরণ থাকায় এ মামলার বিচার নিয়ে মানিক সাহার স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এক সময় এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি তুলেছিলেন। ছুটে এসেছিলেন নিহতের পরিবারে কাছে। এতে করে খুলনা অঞ্চলের মানুষ আশা করেন, বর্তমান সরকারের আমলেই হত্যাকাণ্ডটির রহস্য উন্মোচিত হবে। শাস্তি পাবে প্রকৃত দোষীরা।
খুলনার সাংবাদিক, রাজনৈতিক ও সাধারণ মানুষ মনে করেন, একুশে পদকে ভূষিত করে যে সম্মান দেওয়া হয়েছে সাংবাদিক মানিক সাহাকে, ঠিক সেভাবেই হত্যাকাণ্ডটির সুষ্ঠু ও পুনর্তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দেবে এই সরকার।
এদিকে, মানিক সাহার ১১ম মৃত্যুবার্ষিকী পালন উপলক্ষে খুলনা প্রেসক্লাব, খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়ন, মানিক সাহা স্মৃতি পরিষদ, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, রতন সেন পাবলিক লাইব্রেরিসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন এবং নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে বৃগস্পতিবার বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, সাংবাদিক মানিক সাহা ১৯৫৬ সালের ১০ জুন নড়াইল জেলার কালিয়া থানার চালিতাতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক পাঠশালায় তার লেখাপড়া শুরু।
১৯৬৬ সালে চালিতাতলা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তিনি পঞ্চম শ্রেণী উত্তীর্ণ হন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী।
১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় তিনি এসএসসি পাস করেন। উচ্চমাধ্যমিক পড়েন কালিয়ারই শহীদ আবদুস সালাম কলেজে। তারপর চলে আসেন খুলনায়। পড়েন সিটি কলেজ ও বিএল কলেজে।
ছাত্রাবস্থা থেকেই মানিক সাহা ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে যুক্ত হন, জেলা সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
মানিক সাহা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সদস্য ছিলেন। প্রথমবার ১৯৭৬ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে এবং দ্বিতীয়বার স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী গণআন্দোলনের কারণে, যথাক্রমে ২৪ ও ৪ মাস কারাভ্যন্তরে ছিলেন তিনি।
প্রথমবার কারাগার থেকেই বিএ পরীক্ষায় অংশ নেন। পরে এমএ ও এলএলবি পাস করেন।
১৯৯০ সাল থেকে তিনি সাংবাদিকতায় বেশি সময় দিতে শুরু করেন। অবশেষে এই মানুষটিকে থামিয়ে দেওয়া হয় ২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি।
বাংলাদেশ সময়: ০৪৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৫