ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বাধা পেরিয়ে তারা স্বপ্ন পূরণের পথে...

অপু দত্ত, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০১৫
বাধা পেরিয়ে তারা স্বপ্ন পূরণের পথে... ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

খাগড়াছড়ি: সমাজের অন্য দশটা সাধারণ মানুষের মতো স্বাভাবিক না হওয়ায় প্রতিবন্ধীদের চলতে-ফিরতে অনেক বাধার সম্মুখিন হতে হয়।

তবে সমাজের এতসব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে নিজেদের অন্য সব মানুষের মতো প্রামাণ করে স্বপ্ন করে চলেছে কনসার্ন সার্ভিসেস্ ফর ডিসআ্যাবলেড (সিএসডি) নামে একটি প্রতিষ্ঠান।

খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার বাঘাইছড়ি দু’আর এলাকায় প্রতিবন্ধীদের নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানের রূপকার বিশ্বজিৎ দাশ গুপ্ত নিজেই একজন প্রতিবন্ধী।

এখানে কেউ সেলাই প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, কেউ শিখছে কম্পিউটার। কেউবা তাঁতের কাজ, কেউ নিচ্ছেন চারুকলা ও সংগীত প্রশিক্ষণ।

আর যারাই প্রশিক্ষণ নিচ্ছে তাদের সঙ্গে সুস্থ সবল একজনের মানুষের পার্থক্য শুধু একটিতে। তারা সবাই প্রতিবন্ধী। এদের মধ্যে কেউ বাক প্রতিবন্ধী, শ্রবণ প্রতিবন্ধী, কেউবা খর্বাকৃতির।

জানা যায়, ১৯৮৮ সালের ২২ ডিসেম্বর ক্রিকেটের অনুশীলন করতে শাটল ট্রেনে চেপে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হন বিশ্বজিৎ। কিন্তু জংশনে পৌঁছাতেই ছেড়ে দেয় ট্রেন। দৌড়ে ট্রেনে উঠতে গিয়ে পিছলে পড়ে দুই পা চলে যায় ট্রেনের নিচে। আর এ দুর্ঘটনার কারণে বিশ্বজিতের দুই পা কাটা পড়ে।

মেধাবি বিশ্বজিৎ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ পাস করে বের হন।

বছরখানেক পর চট্টগ্রামের নন্দিরহাটে নিজের জায়গায় প্রতিষ্ঠা করেন সিএসডির কার্যক্রম। আর ২০১৩ সালে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় শুরু করেন শাখা কার্যক্রম। দুর্ঘটনায় তিনি দুই পা হারানোর পর থেকে সিএসডির মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ শুরু করেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকার প্রতিবন্ধীদের মানবিক উন্নয়নের চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে সিএসডি’র পার্বত্য শাখার ব্যানারে দীঘিনালায় কাজ শুরু করেন বিশ্বজিৎ। অল্প সময়ে স্থানীয়দের শুধু প্রশংসা কুড়াননি তিনি রীতিমতো হতবাক করেছেন তার উদ্যম ও সহযোগীতা দেখিয়ে।

রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর এলাকার ধীরেন্দ্র চাকমার ছেলে প্রতিবন্ধি শ্যামল চাকমা (৩২)। এক বছর ধরে সিএসডির ছাত্রাবাসে থেকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানে আসার পর থেকে মনে হচ্ছে হুইলচেয়ারে বসে বাকী জীবন অক্ষম থেকে কাটাতে হবেনা। এখানে এসে কম্পিউটার শিখছি। ইচ্ছে আছে নিজ এলাকায় গিয়ে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের দোকান চালু করার।

প্রতিষ্ঠানটির সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ১৭টি সেলাই মেশিনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সেখানে হুইল চেয়ারে বসে কাজ করছে এসপি চাকমা (১৭)। আরেক শ্রবণ প্রতিবন্ধী হাতের কাজ শিখছে। আবার কেউ শিখছে কম্পিউটার। প্রতিবন্ধীদের ধরণ অনুযায়ী তাদের কারিগরী শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৮টি কম্পিউটারের মাধ্যমে চলছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, স্থাপন করা হয়েছে ৬টি তাঁত।

এসপি চাকমা জানায়, পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ে গাছ থেকে পরে দুটো পা ভেঙে যায়। এরপর থেকে দরিদ্র পরিবারের বোঝা হয়ে ঘরে ছিল। ভেবেছিল সারাজীবন এভাবেই কাটাতে হবে। এরকম একটি সুযোগ জীবনে আসতে পারে তা কখনো কল্পনা করেনি।

সিএসডির প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বজিৎ দাশ গুপ্ত বলেন, প্রতিবন্ধীদের কর্মজীবী হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে তারা আর সমাজের বোঝা হয়ে থাকবেনা, নিজেরাও মানসিকভাবে স্বস্তিতে থাকবে, সে উদ্দেশ্যেই এতকিছু করা। প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি বিদ্যালয় করার ইচ্ছা রয়েছে বলেও জানান বিশু।

‘প্রতিবন্ধী নই, প্রতিযোগী হবো’ স্লোগান নিয়ে কারিগরি প্রশিক্ষণসহ প্রতিবন্ধীদের মানবিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। কর্মমুখি করে গড়ে তোলার জন্য নিজস্ব অর্থায়নে সেলাই প্রশিক্ষণ, কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। স্থাপন করেছেন নরসিংদি থেকে আনা তাঁত। এছাড়া সংগীত শিক্ষারও ব্যবস্থা করা হয়েছে।

দুর্গম এলাকা থেকে শারিরীক প্রতিবন্ধীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যাতায়াতের অসুবিধা দূর করতে নির্মাণ করা হয়েছে ছাত্রাবাস; খাবার খরচও চালিয়ে যাচ্ছেন নিজেই। গত ২৭  নভেম্বর প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দেখতে আসেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনার সোমনাথ হালদার।

জানতে চাওয়া হয় প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সম্পর্কে। তিনি বলেন, ‘কর্মযজ্ঞ দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। প্রতিবন্ধীরা যে সত্যিই বোঝা নয় এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম তারই বড় প্রমাণ। তিনি সামর্থ্য অনুযায়ী সবাইকে প্রতিবন্ধীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।

সিএসডির দীঘিনালা শাখার সভাপতি কৃপা রঞ্জন চাকমা বলেন, এই প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধীদের বাঁচতে শেখাচ্ছে। আমরাদের সবার উচিৎ পাশে থাকা। সরকারি, বে-সরকারি সহযোগীতা পেলে প্রতিষ্ঠানটির আরো উন্নয়ন সম্ভব হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৫
এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।