মাওয়া থেকে ফিরে: লোকে তো বলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। কিন্তু ভাই আপনি তো শাক দিয়েই মাছ ঢাকলেন।
মাওয়া ফেরিঘাটের পদ্মা হোটেলে তিন বাটি শাকের দাম ১২০ টাকা বিল কষায় এমন মন্তব্য করে বসেন সহকর্মী হুসাইন আজাদ।
এ কথা শুনেই হোটেলের মধ্যে থাকা অন্যরা হো হো করে হেসে উঠলেন। তবে হোটেল ম্যানেজারের ভাবান্তর হল না। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জবাব দিলেন, আপনাদের কাছে তো কমই রাখলাম, এক বাটি শাক তো ৫০ টাকা বিক্রি হয়।
ইলিশ কেনার আগে দর কষাকষি করেছিলাম। দুইটা ইলিশের দাম হাঁকা হয় ২৪শ‘ টাকা। দরাদরি করে ১৬০০ টাকায় চূড়ান্ত করে মনে মনে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিলাম আমরা। এর পরিণতি যে এমন হবে, ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি।
ইলিশের দাম কিছুটা কম রাখায় তা সুদে-আসলে পুষিয়ে নিতে এভাবেই অন্য সব কিছুর দাম কষলেন হোটেল ম্যানেজার। মাত্র ৫০ গ্রাম আলু ভর্তা ২০ টাকা, এক বাটি বুটের ডাল ৫০ টাকা, এক পিস বেগুন ভাজি ২০ টাকা।
তার এই বিল কষা দেখে রাজধানীর সঙ্গে হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছিলাম। ঢাকার খাবারের হোটেলগুলো তো এভাবে গলা কাটে না। কোনোদিন তো বুটের ডালের মূল্য ৫০ টাকা দিতে হয়নি। কিংবা এক বাটি লাল শাকের দাম তো কখনোই ৪০ টাকা গুনতে হয়নি।
যেখানে রাস্তার ওপর মাত্র দুই টাকায় এক আঁটি শাক বিক্রি হচ্ছে। সেখানে এক বাটি শাকের দাম ৪০ টাকা ভাবা যায়? তখন মনে হলো সহকর্মী হুসাইন আজাদ যথার্থই বলেছেন, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা হয়েছে।
শাক দিয়ে সত্যিকারের মাছ না ঢাকলেও মূল্যের ক্ষেত্রে কিন্তু শুধু ঢেকে দেওয়া হয়নি, দাফন করা হয়েছে- মন্তব্য করলেন বাংলানিউজের স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট খাইরুল আলম রাজীব।
হোটেলে মূল্য তালিকা থাকা বাধ্যতামূলক হলেও এ হোটেলে কোথাও এমন কিছু খুঁজে পাওয়া গেলো না। দোকানিকে মূল্য তালিকার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বলেন, আপনারা যা ভাবছেন আমরা তেমন নই। আমরা কখনোই বেশি দাম নিই না।
তখন মনে পড়ে গেলে সেই নগরবাড়ী ঘাটের কথা। নগরবাড়ী ঘাট সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত আছে, “এক ভদ্রলোক ছেলেকে নিয়ে ডিম দিয়ে ভাত খাচ্ছিলেন। ছেলে দেখল ডিমের মধ্যে বাচ্চা। ছেলেটি তখন তার বাবাকে জানায়, ‘বাবা ডিমের মধ্যে তো বাচ্চা হয়েছে’। ভদ্রলোক ছেলেকে বলে ওঠেন, ‘আস্তে বল, জানতে পারলে কিন্তু মুরগীর রোস্টের দাম আদায় করবে’। ”
গল্পটি হয়তো গল্পই কেবল। কিন্তু এ গল্প দিয়ে নগরবাড়ীর দোকানিদের অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরা হতো। নগরবাড়ীর এসব গল্প সেই বিংশ শতাব্দীর। নগরবাড়ীর সেই জৌলুস আর নেই, যমুনায় ব্রিজ নির্মিত হওয়ায় মানুষ এখন এক মুহূর্তে নদী পার হয়ে যাচ্ছে।
মাওয়াকে হয়তো হালের নগরবাড়ী বলা যাবে। এই ঘাটে গেলে ফুটন্ত কড়াইয়ে ইলিশ ভাজা খাওয়ার লোভ যারা সংবরণ করতে পারেন না, তারা একটু দরদাম করে খেলে ভালো। প্রত্যেকটি আইটেমের দাম অর্ডারের আগে জেনে নেওয়া উচিত। নতুবা ভর্তা কিংবা ডাল অথবা বেগুন ভাজি দিয়ে ইলিশ ঢেকে দিতে দ্বিধা করবে না দোকানিরা।
আরেকটি কথা বলে রাখতে হয়, খাবার টেবিলে নানা পদ পুশ করতেও সিদ্ধহস্ত মাওয়ার হোটেল বয়গুলো। আমরা যখন খাচ্ছিলাম, না চাইতেই বিভিন্ন পদের তরকারি ধপাধপ প্লেটে ঢালছিলেন তারা।
পরে পাশের হোটেলগুলোতে ঘুরে কোথাও মূল্য তালিকার নিশানা দেখা গেলো না। এমনকি দিনে লাখ লাখ টাকার ব্যবসা করা এই হোটেলগুলোর বেশিরভাগেরই সাইনবোর্ড পর্যন্ত নেই।
স্থানীয়রা জানালেন, এখানে নাকি স্যানেটারি ইন্সপেক্টর মাসে একবার করে আসেন। ‘মাসোহারা নেওয়ার জন্য’।
মজার ব্যাপার হলো, যখন খাওয়া শেষে বিল ভাউচার চাই। তখন ম্যানেজার এমন ভাব দেখালেন, যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, কোনো বিল ভাউচার নেই। এমনকি দোকানের সিল পর্যন্ত নেই। পরে সাদা কাগজে বিল লিখে দিলেন।
কম্পিউটারে ক্যাশ মেমো করার কথা। ক্রেতাকে ক্যাশ মেমো দেওয়া বাধ্যতামূলকও। সেই ক্যাশ মেমোতে ভ্যাট আইডেন্টিফিকেশন নম্বরও (ভিআইএন) থাকার কথা। যার ভিত্তিতে মাসে সরকারের ভ্যাট আদায় হওয়ার কথা।
কিন্তু মাওয়ার হোটেলগুলো দিনে-দুপুরে মানুষের গলা কাটছে, একইসঙ্গে সরকারকেও ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে। এগুলো কি এনবিআর, স্যানিটারি ইন্সপেক্টর বা ভোক্তা অধিদপ্তরের নজরে পড়ে না। নাকি স্থানীয়দের কথাই সত্য, ‘মাসে আসেন মাসোহারা নিতে’!
বাংলাদেশ সময়: ০৬৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০১৫
এসআই/এইচএ